‘ডোরওয়ে ইফেক্ট’– নামটা শুনেই মাথায় আসছে, এটা দরজার সাথে মানব মনের কোনো সংযোগের কাজ কারবার। তাই না?
হ্যাঁ, আপনার চিন্তায় ভুল কিছু আসেনি, আমরা সবাই-ই কমবেশি এই ইফেক্টের অভিজ্ঞতা নিয়ে নিয়েছি। কি বিশ্বাস হচ্ছেনা তো? আচ্ছা, তবে ভেঙেই বলি।
প্রায়ই এমন হয় না; যেন আপনি কোনো কাজের কথা ভাবতে ভাবতে একরুম থেকে অন্যরুমে এলেন, আর হঠাৎ খেয়াল করলেন, আপনি কি জন্য এই রুমে এসেছেন তা আপনার আর মনেই নেই! হ্যাঁ, এটাই হলো ডোরওয়ে ইফেক্ট।
শুধুমাত্র কোনো কাজের ক্ষেত্রেই যে এমন হয়, ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়। কথার ক্ষেত্রেও অনেক সময় এমন হয়। যেমন ধরুন আপনি আপনার কোনো বন্ধুর সাথে কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলছেন। হঠাৎ করে আপনার অন্য কোনো বন্ধু এসে কিছু একটা বলে গেলো আর আপনার মনোযোগ ওদিকে সরে গেল। আর এরপর আপনার অবস্থা, “আরে কোথায় যেন ছিলাম?!” আর তখন লক্ষ্য করেন, আপনি যার সাথে কথা বলছিলেন তার মুখভঙ্গি, “আরে আমি কিভাবে বলব?!”
এই সিচুয়েশনগুলো আসলেই বিব্রতকর, আর এটি হলো আমাদের সাথে সবচেয়ে বেশি ঘটে যাওয়া ডোরওয়ে ইফেক্টের উদাহরণ। আপনি কি ভাবছেন, এটা একমাত্র আপনারই সমস্যা? আপনার স্মরণশক্তি দিন দিন কমে যাচ্ছে তাই এমন হচ্ছে? ব্যাপারটা কিন্তু মোটেই তা নয়। একদম খুব সাধারণ থেকে প্রচণ্ড বুদ্ধিমান, সবরকমের মানুষের সাথেই কম বেশি এটা হয়ে থাকে।
অনেক তো হলো ডোরওয়ে ইফেক্টের উদাহরণ দেওয়া, চলুন এবার জেনে নিই, কেন হয় এমন!
সাইকোলজিস্টদের মতে, কোনো একটা করিডোর দিয়ে এক রুম থেকে অন্য রুমে যাওয়াটা আমাদের মস্তিষ্কে একটি ‘মেন্টাল ব্লক’ তৈরি করে। ব্যাপারটা এমন, আপনি যখন এক রুম থেকে বেরিয়ে অন্য রুমে যাচ্ছেন, তখন আপনার মস্তিষ্ক আগে থেকে চলতে থাকা চিন্তা-ভাবনাগুলোকে হঠাৎ করেই থামিয়ে দিয়ে নতুন কোনো ঘটনার জন্য প্রস্তুত হয়। আর তাই আপনি সাময়িকভাবে ভুলে যান, আপনি কেন এখানে এসেছিলেন বা কি করছিলেন।
অনেকেই ভাবেন, আমাদের মস্তিষ্কের বিভিন্ন ভাগ বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত, ছোট ছোট খুপরির মতো কোষে সব স্মৃতি জমা থাকে। ব্যাপারটা মোটেই এমন নয়। আমাদের মস্তিষ্কের কার্যাবলি আরো অনেক জটিল ও সুক্ষ্ম।
ডোরওয়ে ইফেক্ট আদতে মানুষের মস্তিষ্ক ও স্মৃতি সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার জটিল প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমাদেরকে ধারণা দেয়। আমাদের স্মৃতিগুলো মূলত এপিসোডিক বা পর্বভিত্তিক। কোনো একটা ঘটনার পর অন্য ঘটনা সমান্তরাল ভাবে আমাদের মস্তিষ্কে সংরক্ষিত হয়। কোনো একটা ঘটনাকে আমরা সংরক্ষণ করি বিভিন্ন পর্বে পর্বে ভাগ করে ও সেই ঘটনাকে একজন যেই অংশটা দিয়ে মনে রাখে, দেখা যায় সেই একই ঘটনা অন্য কেউ অন্য আরেকটি অংশ দিয়ে মনে রাখে।
ডোরওয়ে ইফেক্টের কারণ জানতে বিজ্ঞানীদের করা এক্সপেরিমেন্ট গুলোর কথাই যদি বলি, ইউনিভার্সিটি অব নটরডেম এর একদল গবেষক ডজনখানেক মানুষের ওপর করা এক গবেষণার ১ম ধাপে অংশগ্রহণকারীদেরকে টিভিতে একটি ভার্চুয়াল রিয়েলিটির পরিবেশ দেখান, যেখানে ছিলো আশেপাশে ছোট-বড় ৫৫টি রুম ও বড় রুম গুলোর দুই প্রান্তে ২টি টেবিল ও ছোট রুম গুলোয় ১ টি টেবিল।
অংশগ্রহণকারীদের বলা হয় ১ম টেবিলে রাখা বস্তুটিকে অন্য টেবিলে নিয়ে রাখতে এবং অন্য টেবিলটি থেকে আরেকটি বস্তু তুলে নিতে। এবং বিভিন্ন ধাপে করা এই পরীক্ষায় যখন তাদেরকে একই রুমে এক টেবিল থেকে বস্তুটি অন্য টেবিলে রাখার চেয়ে বস্তুটি নিয়ে এক রুম থেকে অন্য রুমে বস্তুটি রাখতে যেতে বলা হয়, তখন সমপরিমাণ দূরত্ব অতিক্রম করলেও দ্বিতীয় ক্ষেত্রে অনেকেই ভুলে গিয়েছিলেন তারা আসলে কি করছিলেন।
এই পরীক্ষার ২য় ধাপে এবার ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে না করে বাস্তব পরিবেশেই তারা এই পরীক্ষাটি করেন ও এবারও তারা একই ফলাফল পান!
এগুলো পড়তে ভুলবেন না !!অ্যাডা লাভলেসঃ বিশ্বের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার ! |
এখানে উৎপত্তি হয় নতুন আরেকটি প্রশ্নের, যদি কোনো দরজা দিয়ে হেঁটে যাওয়া আমাদের ভুলে যাবার কারণ হয়, তবে সেই রুমে ফিরে আসা কি আমাদের এই স্মৃতিহ্রাস থেকে রক্ষা করবে? বা ব্যাপারটা কি এমন, যেখান থেকে আমরা মূল তথ্যটি নিয়েছি সেখানে আমাদের তথ্য গুলো পুনরায় মনে করা সহজ? এই বিষয়টি জানতে বিজ্ঞানীরা ৩য় ধাপের পরীক্ষাটি করেন, যেখানে অংশগ্রহণকারীরা ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে এক রুম থেকে একটি বস্তু তুলে নিয়েছিলেন এবং একটি দরজা দিয়ে হেঁটে সেই রুম থেকে বেরিয়ে যেয়ে অন্য আরেকটি দরজা দিয়ে প্রবেশ করেন, যা তাদেরকে হয়ত একটি নতুন রুমে নিয়ে আসবে বা আগের রুমটায় ফিরিয়ে আনবে। এবং এক্ষেত্রেও বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেন, আগের রুমে ফিরে আসা সেই স্মৃতিটাকে ফিরিয়ে আনছে না।
ডোরওয়ে ইফেক্ট আমাদের স্মৃতি সংরক্ষণের একটা বিশেষ দিক তুলে ধরে, আমাদের কোনো কিছু মনে করা বা পুনরায় স্মরণ করা নির্ভর করে সেই ঘটনার দিকে আমরা কিভাবে মনোযোগ দিয়েছিলাম, কখন বা কত আগে ঘটেছিলো এবং ঘটনাটি পুনরায় মনে করার জন্য কত বেশি চেষ্টা করছি। আমাদের শারীরিক ভাবে অবস্থানের পরিবর্তনের সাথে সাথে আমাদের মানসিক ভাবেও অবস্থা বা পরিবেশ পরিবর্তিত হয়। এটি কে Location Updating Effect ও বলা হয়।
মস্তিষ্ক হলো ১০০ বিলিয়ন নিউরনের তৈরি আমাদের দেহের মূল কন্ট্রোল সেন্টার, যার সাহায্যে আমরা আসলেই নানা অসাধারণ চিন্তা, কাজ, আবিষ্কার করতে পারি। আর ভালো খবরটি হলো, ডোরওয়ে ইফেক্টের বদৌলতে এই ভুলে যাওয়ার ঘটনা গুলো মোটেই আমাদের স্মৃতিশক্তি, চিন্তন দক্ষতা বা বুদ্ধিমত্তার মাত্রা নির্দেশ করেনা। আর তাই, এখন থেকে একরুম থেকে অন্যরুমে যেয়ে যদি ভুলে যান আপনি কেন এসেছিলেন, তাহলে আবার নিজেকে স্মৃতিহ্রাস বা আলঝেইমারের রোগী ভেবে হা-হুতাশ করবেন না যেন!
তথ্যসূত্রঃ BBC, ScienceABC, Scientific American, The Student Scientist