এন্টিবায়োটিক ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট জীবাণু এর কথা তো আমরা কম বেশি সবাই জানি, তাই না? আচ্ছা মাল্টিড্রাগ-রেজিস্ট্যান্ট- টিউবারকিউলোসিস বা MDR-TB এর কথা কি আপনারা জানেন? (যক্ষ্মা এর জীবাণু)
যক্ষ্মা বা টিবি রোগের জন্য যেই ব্যাকটেরিয়া দায়ী সেটি যক্ষ্মার জন্য ব্যবহৃত অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ড্রাগ বা ওষুধের বিরুদ্ধে রেজিস্ট্যান্ট তৈরি করে রোগীর শরীরে। ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স কি এটা আমি আরেকবার মনে করিয়ে দেই সবার সুবিধার্থে, ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স হলো ব্যাকটেরিয়া এবং অন্যান্য অণুজীবের একটি ড্রাগকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা যে ড্রাগ একবার তাদের নিস্ক্রিয় করে দেয় বা তাদের মেরে ফেলে। অ্যান্টিবায়োটিকের পাশাপাশি যক্ষ্মা বা টিবিতেও ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয় যেটা MDR-TB (Multidrug-resistant TB) নামে পরিচিত। Isoniazid এবং Rifampicin এই দুটি শক্তিশালী অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল ড্রাগও কাজ করে না যদি রোগীর দেহে MDR-TB ডেভেলপ করে।
মূলত ২ টি কারণে মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্স আবির্ভূত হয় এবং ছড়িয়ে পড়ে-
১. যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসায় অব্যবস্থাপনা এবং অসতর্কতা
২. ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির মধ্যে সংক্রমণ।
বেশির ভাগ যক্ষ্মা রোগী ৬ মাসের কঠোর ওষুধের কোর্স ও চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্কর্মীদের সহায়তায় সুস্থ হয়। অনুপযুক্ত বা ভুল অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ড্রাগের ব্যবহার বা অকার্যকর ওষুধের ফর্মূলেশন, যেমনঃ একক ওষুধ ব্যবহার, নিম্নমানের ওষুধ, নিম্নমানের ওষুধ সংরক্ষণ ব্যবস্থা এবং ওষুধের সঠিক কোর্সের নিয়ম না মানার কারণে ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স হয় যা কিনা দ্রুত সংক্রমিত হয়ে পড়ে বিশেষত জনবহুল স্থান; হাসপাতাল, জেলখানার মতো জায়গায়।
যক্ষ্মা রোগে ওষুধের সঠিক কোর্স এবং চিকিৎসক নির্দেশিত নিয়মাবলি অত্যাবশ্যকীয়। কেন না ওষুধের কোর্স সম্পূর্ণ না করলে এবং সঠিক নিয়ম ছাড়া একই ওষুধ দীর্ঘদিন গ্রহণ করলে যক্ষ্মা এর জীবাণু বা ব্যাকটেরিয়াগুলো ওষুধের গঠনগত দিক চিনে ফেলে বিধায় নিজেদের বেঁচে থাকার তাগিদে ব্যাকটেরিয়াগুলো নিজেদের মধ্যে জেনেটিক মিউটেশন করে ফেলে ও গঠনগত পরিবর্তন এবং তাদের কাজের ধরন পরিবর্তন করে সেই ওষুধকে অকার্যকর করে ফেলে।
আরেকটি ব্যাপার হলো, ব্যাকটেরিয়াগুলো তাদের মেমোরিতে ঔষধের ধরন এবং কাজগুলোকে সেভ করে রাখে যার ফলে তাদের পরবর্তী জেনারেশনকে ও তারা এর বিরুদ্ধে কাজ করতে শিখিয়ে দিয়ে যায়। যার ফলে ঐ ব্যক্তির দেহে ঐ অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ড্রাগ বা ওষুধটি রেজিস্ট্যন্ট হয়ে যায় অর্থাৎ কাজ করা বন্ধ করে দেয়। MDR-TB তে আক্রান্ত ব্যক্তির থেকে হাঁচি, কাশি ইত্যাদির মাধ্যমে এটি অন্য ব্যক্তির দেহে সংক্রমিত করতে পারে।
কিছু দেশে MDR-TB এর চিকিৎসা করা ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে। চিকিৎসার বিকল্পগুলোতে রয়েছে নানবিধ সীমাবদ্ধতা এবং এটি ব্যয়বহুল ও বটে। এই রোগের ওষুধ সবসময় পাওয়া যায় না এবং রোগীদের মধ্যে ওষুধের বিভিন্ন বিরূপ প্রভাব (adverse effect) লক্ষ্য করা যায়। XDR-TB হলো MDR-TB এর আরেকটি রুপ যেটি আরো কয়েক প্রকার অ্যান্টি টিউবারকিউলোসিস ড্রাগের বিরুদ্ধে রেজিস্ট্যান্ট তৈরি করে এবং খুব কম ওষুধে সাড়া দেয় বা কাজ করে এটি।
এবার কথা বলবো আরেকটি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স XDR-TB (Extensively Drug-Resistant Tuberculosis) যেটি কিনা MDR-TB এরই আরেকটি ফর্ম বা রুপ, যা কমপক্ষে ৪ টি মূল Anti-TB drug কে রেজিস্ট্যান্স করে। XDR-TB দুটি সর্বাধিক শক্তিশালী অ্যান্টি-টিবি ড্রাগ, আইসোনিয়াজিড এবং রিফাম্পিসিন রেজিস্ট্যান্সের সাথে জড়িত যেটিকে MDR-TB ও বলা হয়ে থাকে। এছাড়াও Fluoroquinolones জাতীয় ড্রাগ যেমন, levofloxacin বা moxifloxacin রেজিস্ট্যান্সের পাশাপাশি ইনজেকশনযোগ্য সেকেন্ড-লাইনের ওষুধের মধ্যে কমপক্ষে একটি ওষুধ (amikacin, capreomycin, kanamycin) কে রেজিস্ট্যান্স করে ফেলে।
MDR-TB এবং XDR-TB উভয়ই সাধারণ (drug-susceptible বা ড্রাগ-সংবেদনশীল) টিবির চেয়ে ট্রিটমেন্টে রোগীকে সুস্থ করতে যথেষ্ট সময় নেয়, এবং সেকেন্ড-লাইনের অ্যান্টি-টিবি ঔষধের ব্যবহার প্রয়োজন, যা অনেক ব্যয়বহুল এবং ফার্স্ট-লাইনের ওষুধের চেয়ে বেশি সাইড ইফেক্ট রয়েছে যা ড্রাগ-সংবেদনশীল টিবিতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
XDR-TB মূলত রোগীর দেহে ডেভেলপ করে MDR-TB এর মতোই যেটি আমি উপরে উল্লেখ করেছি। তবে একটি কথা, XDR-TB একজনের দেহ থেকে আরেকজনের দেহে সংক্রমিত হলেও যদি ঐ ব্যক্তির দেহে টিবি রোগের জীবণু থাকে তবেই সেটি সক্রিয়ভাবে কাজ করবে এবং ডেভেলপ করবে। তাই যারা সাধারণ টিবি রোগে আক্রান্ত এবং যারা তাদের চিকিৎসা করেন তাদের অনেক সতর্ক থাকতে হবে।
১. এক জায়গায় অনেক ভীড়ের মধ্যে থাকা যাবে না
২. নির্দিষ্ট দূরত্বে থাকতে হবে এক রোগী থেকে অন্য রোগীর।
৩. যেখানে হাঁচি,কাশি দেয়া যাবে না এবং কফ,থুথু ফেলা যাবে না
৪. মুখে মাস্ক কিংবা রুমাল এবং হাতে গ্লাভস ব্যবহার করতে হবে।
৫. সাধারণ টিবি রোগীদের অবশ্যই সঠিক নিয়ম মেনে ওষুধ খেতে হবে এবং ডাক্তারের দেয়া নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। যদি কোনো ওষুধে সমস্যা বা সাইড ইফেক্ট দেখা দেয় তাহলে সাথে সাথে সেটা ডাক্তার বা নার্সকে জানাতে হবে।
XDR-TB রোগের নিরাময় করা যায়, তবে বর্তমানে যে ওষুধ পাওয়া যায় তা সাধারণ টিবি বা এমনকি এমডিআর-টিবি রোগীদের তুলনায় সাফল্যের সম্ভাবনা অনেক কম। এর নিরাময় নির্ভর করে ওষুধের প্রতিরোধের পরিমাণ, রোগের তীব্রতা এবং রোগীর দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা (immune system) কেমন অবস্থায় আছে এসবের ওপর। তবে HIV তে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে এর মৃত্যুর হার বেশি হওয়ার সম্ভবনা থাকে কেননা তাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম বা নেই বললেই চলে।
এগুলো পড়তে ভুলবেন না ! আমাদের অজ্ঞতা এবং উদাসীনতা: অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স |
তবে দ্রুত যদি XDR-TB এর চিকিৎসা করানো যায় এবং সেকেন্ড-লাইন ড্রাগের সঠিক নির্বাচন এবং ব্যবহারে ডাক্তার অভিজ্ঞ থাকেন তাহলে দ্রুত নিরাময় সম্ভব। এর আলাদা করে কোনো টিকা বা প্রতিষেধক নেই। BCG টিকাই আপাতত টিবি (যক্ষ্মা এর জীবাণু) এর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
WHO এর এক রিপোর্ট অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত MDR-TB এ বিশ্বব্যাপি ৪৭% মানুষ আক্রান্ত এবং এর মাত্র ৬.২% XDR-TB তে রুপান্তরিত হয়েছে। তাই এটা কে এখন পর্যন্ত বিরল রোগ বলা যায়।
২০১৬ সালে, বিশ্বব্যাপী আনুমানিক ৪৯০,০০০ জন লোকের MDR-TB তে আক্রান্ত হয় এবং রিফাম্পিসিন-রেজিস্ট্যান্স টিবিসহ আরো ১১০,০০০ মানুষ MDR-TB এ নতুনভাবে আক্রান্ত হয়। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক MDR-TB/RR-TB এ আক্রান্ত দেশ হলো চীন, ভারত এবং রাশিয়া।
ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স টিবি নিয়ন্ত্রণের সমাধানগুলো হলোঃ
১. প্রথমবারেই টিবি রোগীকে চিকিৎসা করে সুস্থ করতে হবে।
২. ডায়াগনোসিস বা টেস্ট করতে হবে।
৩. যেখানে রোগীদের চিকিৎসা করা হয় সেখানে পর্যাপ্ত সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে হবে।
৪. প্রস্তাবিত সেকেন্ড-লাইনের ওষুধগুলোর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
স্পেশাল ল্যাব টেস্টের মাধ্যমে ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স সনাক্ত করা যায়। এই টেস্ট সাধারণত মলিকিউলার বা কালচার বেসড হয়ে থাকে।
টিবি রোগের চিকিৎসা এবং এর ওষুধের রেজিস্ট্যান্স নিয়ে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন স্বাস্থ্য সংস্থা বিশেষত WHO অনেক কাজ করছে, কীভাবে এটি প্রতিরোধ করা যায়, এর দ্রুত প্রতিকার এবং সচেতনতা নিয়ে। আমাদের ও এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে শুধু এন্টিবায়োটিক বা এন্টি-টিবি ড্রাগ নয় অন্য কোনো রোগের ওষুধই যেনো আমাদের দেহে রেজিস্ট্যান্ট না হতে পারে।