আচ্ছা, যখন আমাদের হাত খুব বাজেভাবে কেটে যায়, তখন আমাদের হাতে সেলাইয়ের প্রয়োজন হয়, তাই না? এরকম সেলাইয়ের সময় আমাদের উপর লোকাল এনেস্থিসিয়া ব্যবহার করা হয়। এতে ক্ষতস্থান অবশ হয়ে পড়ে এবং আমাদের ব্যথা অনুভব হয় না। কিন্তু যদি কারো ক্ষতস্থানে লোকাল এনেস্থিসিয়া ব্যবহার ছাড়াই সেলাই শুরু করা হয়, তাহলে সেই ব্যক্তির ব্যথায় নাজেহাল অবস্থা হওয়ার কথা, কিন্তু কেমন হবে যদি আপনার চোখের সামনেই এরকম একটা ঘটনা ঘটছে, অথচ সেই ব্যক্তির মুখে বিন্দুমাত্র আর্তনাদের ভাবলেশ নেই? মনে হচ্ছে ব্যক্তিটা আরো মুহূর্তটাকে উপভোগ করছে! অসম্ভব মনে হলেও এমনটা সত্যিকার অর্থেই ঘটতে পারে, যদি ব্যক্তিটি CIPA রোগাক্রান্ত হয়।
CIPA এর পূর্ণরূপ হলো Congenital insensitivity to pain with anhidrosis। এই রোগটির ২ ধরনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যথা:
- ব্যথা এবং তাপমাত্রা অনুভবে অক্ষমতা
- ঘাম কমে যাওয়া বা এর অনুপস্থিতি (Anhidrosis)
এই অবস্থাটিকে Hereditary sensory and autonomic neuropathy type IV নামেও উল্লেখ করা হয়।
- Hereditary বলা হয় কেননা এটি বংশগত রোগ
- Sensory বলা হয় কারণ এটি শরীরের সংবেদনশীল স্নায়ুগুলোকে প্রভাবিত করে
- Autonomic কারণ এটি Autonomic nervous system কে প্রভাবিত করে (এই সিস্টেমই মূলত ঘাম নিঃসরণে সহায়তা করে)
CIPA এর লক্ষণ ও উপসর্গ:
CIPA এর লক্ষণ ও উপসর্গগুলো সাধারণত জন্মের সময় বা শৈশবকালেই দেখা যায়। সতর্কতা অবলম্বনের সাথে সাথে যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে এ রোগে আক্রান্ত রোগীরা প্রাপ্তবয়স্ক হতে পারে।
এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা যেহেতু ব্যথা ও তাপমাত্রা অনুভব করতে পারে না, তাই তাদের দেহে কোনো গুরুতর আঘাত পেলেও তারা উপলব্ধি করতে পারে না। যেমন, একটা ছোট বাচ্চার পা যদি গরম পানিতে পড়ে এবং পা পুড়ে যায়, কিন্তু বাচ্চা যদি কান্না না করে, তাহলে আপনি মনে করতে পারেন যে, বাচ্চাটা শক্ত তাই কান্না করছে না।
কিন্তু এই ধারণা ভুল, এধরনের বাচ্চাগুলো CIPA তে আক্রান্ত হতে পারে যার কারণে বাচ্চাটি তার পায়ের ব্যথা অনুভব করতে পারছে না। একইসাথে বাচ্চাটি যেহেতু গরম পানিতে পা দেয়ায় তার কোনো ব্যথা অনুভব হয় না, তাই সে বুঝতেও পারবে না যে গরম পানি তার জন্য বিপজ্জনক এবং এর থেকে দূরে থাকা ভালো। এতে বাচ্চাটি একই দূর্ঘটনা বারবার ঘটাতে পারে।
ব্যথা হলো শরীরের অ্যালার্ম সিস্টেম। যখনই আমরা শরীরের কোনো অঙ্গে ব্যথা অনুভব করি, তখন আমরা বুঝতে পারি যে, সেখানে হয়তো কোনো ব্যাধি বাসা বেঁধেছে কিংবা সেই স্থানে আঘাত পেয়েছি। কিন্তু ব্যথা অনুভূত না হলে আমরা এগুলো কিছুই বুঝতে পারবো না। CIPA আক্রান্ত ব্যক্তিরাও তাদের দেহে কোনো রোগব্যাধি আছে কিনা তা বুঝতে পারে না, ফলে তারা সহজেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
যেমন, আমরা একটি ভাঙা পায়ের ব্যথা অনুভব করলে সে পা দিয়ে কিছু করবো না এবং বিশ্রামে থাকবো। কিন্তু CIPA আক্রান্ত ব্যক্তি তার পা ভেঙেছে তা বুঝতেই পারবে না এবং ভাঙা পায়ের উপর আরো জোর দিবে। বারবার এধরনের ঘটনার কারণে হাড়ের ক্রনিক ইনফেকশন (অস্টিওমাইলাইটিস) বা চারকোট জয়েন্ট নামক একটি অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে, যেখানে জয়েন্টের আশেপাশের হাড় এবং টিস্যু ধ্বংস হয়ে যায়।
- CIPA আক্রান্ত রোগীরা অনিচ্ছাকৃতভাবে স্ব-আঘাত, যেমন সাধারণ ব্যক্তিদের মতো জিহ্বা, ঠোঁট বা আঙ্গুল কামড়াতে যেয়ে উক্ত স্থানের স্বতঃস্ফূর্ত অঙ্গচ্ছেদ ঘটাতে পারে।
- সাধারণত ঘাম শরীরের তাপমাত্রা ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে। কিন্তু CIPA আক্রান্ত ব্যক্তিদের দেহে যেহেতু ঘাম অনুপস্থিত থাকে তাই বারবার তারা অত্যন্ত উচ্চ জ্বর (হাইপারপাইরেক্সিয়া) এবং উচ্চ তাপমাত্রার কারণে জ্বরজনিত খিঁচুনি ঘটে।
এই দুইটি বৈশিষ্ট্য ছাড়াও CIPA এর অন্যান্য লক্ষ্মণ ও উপসর্গ রয়েছে। অনেক আক্রান্ত ব্যক্তির হাতের তালু, আঙুলের নখ কিংবা পায়ের নখে পুরু স্তর যুক্ত চামড়া (লাইকেনিফিকেশন) থাকে। তাদের মাথার ত্বকে অল্প পরিমাণ খালি জায়গা থাকতে পারে যেখানে কখনই চুল গজায় না (হাইপোট্রাইকোসিস)। CIPA তে আক্রান্ত প্রায় অর্ধেক ব্যক্তি হাইপারঅ্যাকটিভিটি বা মানসিক অস্থিরতার লক্ষ্মণ দেখায়। এ রোগের অল্পসংখ্যক কিছু ব্যক্তি বুদ্ধিবৃত্তিক অক্ষমতাও দেখায়। কিছুসংখ্যক রোগীর অল্পবয়সে দুর্বল পেশিস্বর (হাইপোটোনিয়া) দেখা যায়, কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাদের পেশি দৃঢ় হয় এবং কন্ঠস্বর স্বাভাবিক হয়ে আসে।
CIPA একটি দুর্লভ ব্যাধি এবং এর ব্যাপকতা এখনও অজানা।
CIPA এর পেছনে দায়ী জিন:
ক্রোমোজোম ১ এ অবস্থিত NTRK1 (Neurotrophic tyrosine receptor kinase 1) জিনে মিউটেশনের কারণে CIPA হয়। NTRK1 রিসেপ্টর স্নায়ুকোষের (নিউরন) বেঁচে থাকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। NTRK1 জিন একটি রিসেপ্টর প্রোটিন তৈরির নির্দেশনা প্রদান করে যা NGFβ (Nerve Growth Factor beta) নামক অন্য প্রোটিনের সাথে সংযুক্ত হয়।
NTRK1 রিসেপ্টর কোষের পৃষ্ঠদেশে পাওয়া যায়, বিশেষ করে সেই নিউরন কোষগুলোতে যেগুলো ব্যথা, তাপমাত্রা এবং স্পর্শের সংকেত গ্রহণ করে মস্তিষ্কে প্রেরণ করে। যখন NGFβ প্রোটিন NTRK1 রিসেপ্টরের সাথে যুক্ত হয়, তখন কোষাভ্যন্তরে কোষের বৃদ্ধি এবং বিভক্ত হওয়ার নির্দেশ প্রেরিত হয় এবং কোষকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে।
কিন্তু NTRK1 জিনের মিউটেশন এটিকে এমন একটি প্রোটিনের সাথে সংযুক্ত করে যা সংকেত প্রেরণে অক্ষম। সঠিক সংকেত ছাড়া নিউরনগুলো অ্যাপোপটোসিস অর্থাৎ, নিজেকে নিজে ধ্বংস করার প্রক্রিয়ায় ধাবিত হয়। সংবেদনশীল এসকল নিউরনের ধ্বংসের ফলে CIPA আক্রান্ত ব্যক্তিদের তাপমাত্রা, ব্যথা অনুভবের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। একইসাথে, তারা ঘর্মগ্রন্থির স্নায়ু হারিয়ে ফেলে যার দরুণ তাদের মাঝে অ্যানহাইড্রোসিস দেখা দেয়।
CIPA বংশগতির ধারায় কীভাবে পরিচালিত হয়?
CIPA এর জিনোম Autosomal Recessive Pattern এ উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হয়, যার অর্থ প্রতিটি কোষেই জিনটির উভয় কপিরই মিউটেশন হয়ে থাকে। Autosomal Recessive Condition এ আক্রান্ত বাবা-মা প্রত্যেকে পরিবর্তিত জিনের একটি অংশ বহন করে, কিন্তু তাদের মধ্যে এর কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না।
CIPA নির্ণয়:
CIPA নির্ণয়ের জন্য কোনো সহজ পরীক্ষা নেই। তবে রোগ নির্ণয়ের জন্য বেশ কিছু পদ্ধতি রয়েছে।
- যেমন, ছোট একটি টিস্যুর নমুনা সংগ্রহ করে তা মাইক্রোস্কোপের (বায়োপসি) নিচে দিয়ে এতে অনুন্নত স্নায়ু এবং কোনো ঘর্মগ্রন্থির অনুপস্থিতি রয়েছে কিনা তা দেখা যায়।
- CIPA এর জন্য সবচেয়ে সুনির্দিষ্ট ডায়াগনিস্টিক পরীক্ষা হলো একটি অস্বাভাবিক NTRK1 জিন খোঁজার জন্য জেনেটিক পরীক্ষা করা। জন্মের আগে কিংবা রোগাক্রান্ত ব্যক্তির জীবনের যেকোনো সময় এই পরীক্ষা করা যেতে পারে।
চিকিৎসা:
CIPA এর কোনো প্রতিকার নেই। এমন কোনো চিকিৎসা নেই যা ব্যক্তির তাপ, ব্যথার সংবেদন গ্রহণকারী নিউরনগুলোকে ফিরিয়ে দিতে পারে কিংবা ব্যক্তির দেহে ঘামের সৃষ্টি করতে পারে।
CIPA এর সাথে মোকাবেলা:
CIPA এর জন্য একমাত্র চিকিৎসা হলো এই অবস্থার সাথে সম্পর্কযুক্ত সকল ঝুঁকি থেকে যতটা সম্ভব নিরাপদে থাকা। CIPA তে আক্রান্ত শিশুদের ছোট থেকেই বুঝাতে হবে কীভাবে সাবধানতার সাথে নিজেদের ক্রিয়াকলাপ পরিচালনা করতে হয় এবং বিপদজনক জিনিস হতে দূরে থেকে কীভাবে নিজের যত্ন নিতে হয়। কারণ অন্যান্য স্বাভাবিক বাচ্চাদের মতো তারা নিজেদের বিপদ থেকে বাঁচানোর জন্য ব্যথা বা তাপমাত্রার সংকেত পাবে না।
CIPA এ আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে অ্যানহাইড্রোসিস (ঘামের অনুপস্থিতি) এর কারণে হিট স্ট্রোক হতে পারে।
হিট স্ট্রোক একটি মেডিকেল ইমার্জেন্সি। হিট স্ট্রোকের নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে:
- শরীরের তাপমাত্রা ১০৩° এর উপরে
- গরম, লাল, শুষ্ক ত্বক
- দ্রুত, শক্তিশালী পালস
- মাথাব্যথা
- বমি বমি ভাব
- বিভ্রান্তি
- চেতনা হারানো
CIPA আক্রান্ত শিশুর উচ্চজ্বর হলে:
- তাদের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের দ্বারা অনুমোদিত আইবুপ্রোফেন, অ্যাসিটামিনোফেন বা ন্যাপরোক্সেন জাতীয় ওভার-দ্য-কাউন্টার জ্বর হ্রাসকারী ওষুধগুলো দেয়া যেতে পারে।
- ঠান্ডা পানি বা বরফ স্নানে শরীরের তাপমাত্রা কমার পরিবর্তে আরো বাড়তে পারে, তাই এর পরিবর্তে ঠান্ডা কম্প্রেস ব্যবহার করা যেতে পারে।
যেহেতু CIPA আক্রান্ত ব্যক্তির দেহ ঠান্ডা রাখতে প্রয়োজনীয় যথেষ্ট পরিমাণ ঘাম নিঃসৃত হয় না, সেহেতু তাদের কার্যকলাপও সেভাবেই পরিচালনা করতে হবে। কিছু সতর্কতা:
- গরম পরিবেশে পরিশ্রম এড়িয়ে চলতে হবে
- বাইরে বের হলে যতটা সম্ভব ছায়ায় থাকতে হবে
- গরমে প্রায়ই বিশ্রাম নিন
- হালকা, ঢিলেঢালা, সুতি-র মতো ফাইবার দিয়ে তৈরি হালকা রঙের পোশাক পড়ুন
- সম্ভব হলে বাড়ির ভিতরে এয়ার কন্ডিশনার ব্যবহার করুন
- শীতল পণ্য ব্যবহার করুন
- ঠান্ডা স্নান করুন (বিশেষ করে ব্যায়ামের আগে ও পরে)
CIPA এর সাথে নিরাপদে বাঁচার প্রধান উপায় হলো ভালো চিকিৎসা সেবা এবং জীবন ধারার পরিবর্তন। এই কৌশলগুলো নির্ণয়ের সাথে সাথে প্রয়োগ করা উচিত এবং সারাজীবনের প্রয়োজানুসারে সামঞ্জস্য করে চলা উচিত।
“যে রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যথা অনুভব হয় না” লাইনটি পড়ে যদি মনে একবারও এই কথাটা জেগে উঠে যে, “বাহ! এরকম রোগ হলে তো কোনো অসুবিধাই নেই, পুরো ব্যথামুক্ত জীবন।” এই ব্লগটি পড়া শেষে হয়তো বুঝতে পারবেন যে, ব্যথাও জীবনের জন্য কত বড় প্রয়োজনীয় একটি নিয়ামত।
তথ্যসূত্র: মেডিলাইন প্লাস, ভেরিওয়েল হেলথ