যক্ষ্মা Mycobacterium tuberculosis নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংগঠিত একটি সংক্রামক রোগ যার প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশে প্রকট, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে সপ্তম এবং পৃথিবীর ৪ শতাংশ যক্ষ্মা আক্রান্ত রোগীই বাংলাদেশের। যেহেতু এটি একটি ব্যাকটেরিয়াঘটিত রোগ, তাই চিকিৎসার জন্য এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়।
যক্ষ্মা চিকিৎসায় ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিকগুলো একজন রোগীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে কিনা সেটি নিশ্চিত হওয়া পূর্বক রোগীর চিকিৎসা পরিকল্পনা করা হয় এবং চিকিৎসা বেশ সময়সাপেক্ষ। চিকিৎসা শুরুর আগেই একজন রোগী কোন কোন এন্টিবায়োটিক এর প্রতি সেনসিটিভ, এবং কোনটির প্রতি সেনসিটিভ না সেটা জানা জরুরি। এটি জানার জন্য যে ডায়াগনোসিসটি করা হয় তার নাম হলো Drug susceptibility test.
যক্ষ্মা রোগে First-line treatment এ ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিকগুলো হলো Isoniazid, Rifampicin, Streptomycin ও Ethambutol. সাধারণত এই ৪ টি এন্টিবায়োটিক ৬ মাস চলমান রাখতে হয়।তাই এই ৪ টি এন্টিবায়োটিকের কোনো একটির প্রতি যদি কেউ resistant হয়, তাহলে তার চিকিৎসার জন্য বিকল্প ঔষধ চিন্তা করতে হয় এবং যা চিকিৎসার সময়কালকে আরো দীর্ঘায়িত করতে পারে।
তবে এই ৪ টি এন্টিবায়োটিকের এক বা একাধিকটির প্রতি resistant থাকলেও এখন অন্যান্য বিকল্প এন্টিবায়োটিক দ্বারা সহজেই যক্ষ্মা রোগীর চিকিৎসা করা সম্ভব। এই বিকল্প এন্টিবায়োটিকগুলো কে বলা হয় Second-line drug. অর্থাৎ first-line ৪টি ঔষধ দ্বারা ভালো ফলাফল না পাওয়া গেলে বা কোনো রোগী resistant থাকলে তার ক্ষেত্রে Second-line drug এর কথা চিন্তা করা হয় এগুলোর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরণের Fluoroquinolone, Ethionamide, Prothionamide, Cycloserine, Kanamycin, Capreomycin ও Amikacin. Drug resistance এর আবার বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে যেমন :
- Any Drug-Resistant: যেকোনো একটি first line বা second line Drug-Resistant.
- Mono Drug-Resistant: শুধুমাত্র একটি first line বা second line Drug-Resistant.
- Multi Drug-Resistant: Isoniazid এবং Rifampicin এই দুটি ড্রাগের প্রতি একই সাথে resistant.
- Extensive Drug-Resistant: Isoniazid এবং Rifampicin, যেকোনো একটি Fluoroquinolone এবং Kamamycin, Capreomycinও Amikacin এই তিনটির যেকোনো একটির প্রতি একই সাথে resistant.
সম্প্রতি ১৯৯৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ১৩৩৩৬ জন যক্ষ্মা রোগীর তথ্য নিয়ে করা একটি মেটা-এনালাইসিস এ দেখা গেছে প্রায় ৪৫% বাংলাদেশি যক্ষ্মা রোগীই কোনো একটি এন্টিবায়োটিক এর প্রতি resistant অর্থাৎ Any Drug-Resistant, যা এই পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বিভিন্ন দেশের চেয়ে অনেক বেশি, যেমন: ভারত, নাইজেরিয়া, চীন ও ইরান। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এ হার ৪২.৬%. তবে উল্লিখিত দেশ গুলোর তুলনায় বাংলাদেশে Multi Drug-Resistant রোগীর হার তুলনামূলক কম। কিন্তু তাই বলে যে আসলে হার খুব কম তা ভেবে সন্তুষ্ট হওয়ার যথেষ্ট কারণ নেই কারণ শুধুমাত্র গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ১৩৩৩৬ জনের তথ্যের উপর ভিত্তি করেই এখানে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে কিন্তু প্রতি বছরই হয়তো লাখখানেক বা আরো বেশি রোগী টেস্টিং এর আওতায় আসছেন কিন্তু গবেষণায় সবার তথ্য উঠে আসছে না। চিকিৎসা পদ্ধতি প্রতিনিয়ত উন্নত হলেও Multi Drug-Resistant রোগীর সংখ্যা বাংলাদেশ সহ অন্যান্য দেশে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং কার্যত ১৯৯৯-২০১০ এর তুলনায় প্রায় ১.৫ গুণ রোগী Multi Drug-Resistant যক্ষ্মা রোগী ধরা পড়েছে ২০১০ পরবর্তী সময়ে।
Extensive Drug-Resistant হওয়াটা অনেকটাই দুৰ্ভাগ্যজনক এবং হবার আশঙ্কাও কম থাকে কারণ একইসাথে কমপক্ষে first ও second লাইন এর ৪ ধরণের ড্রাগ এর প্রতিই resistant হতে হয় কিন্তু তবুও এখন ভারত বা পাকিস্তান এর বিভিন্ন সাম্প্রতিক গবেষণায় ১-২% Extensive Drug-Resistant রোগী পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে পর্যাপ্ত গবেষণা নেই, তবুও এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত গবেষণা অনুযায়ী এ হার ০.৩%। যক্ষ্মা চিকিৎসায় ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে Streptomycin এর প্রতি resistance ভারত, নাইজেরিয়া, চীন ইত্যাদি দেশের তুলনায় বেশি পাওয়া গিয়েছে। এন্টিবায়োটিক resistance এর হার নতুন রোগীর তুলনায় পূর্ববর্তী রোগীদের (যারা আগে অন্তত একবার চিকিৎসা গ্রহণ করেছে) ক্ষেত্রে আরো বেশি,
কারণ তারা হয় ঠিকমতো এন্টিবায়োটিক এর কোর্স পালন করেননি অথবা চিকিৎসা শুরুর আগে Drug susceptibility test করেননি যে কারণে তিনি আগে থেকেই কোনো একটি এন্টিবায়োটিক এর উপর resistant ছিলেন কিন্তু টেস্ট করার আগেই ঔষধ শুরু করে তা আগে ধরা পড়েনি এবং চিকিৎসাটি ফলপ্রসূ হয়নি।
পড়তে পারেন এটিও!!! |
মোটা দাগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ার কারণে Drug-Resistant রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বলে ধরে নেয়া যায় কিন্তু কার্যকরী বিকল্প বৃদ্ধি পাওয়ায় সারা পৃথিবীব্যাপীই এখন যক্ষ্মার কারণে মৃত্যুর সংখ্যা ১৯৯০ এর তুলনায় ২০১৭ তে প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। National Tuberculosis Programme (NTP) এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০০৫ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ৯৫% রোগীকে সঠিকভাবে চিকিৎসার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে এবং ১৯৯০ এর তুলনায় মৃত্যুহার কমানো গিয়েছে ৮৮% এর চেয়েও বেশি।
যক্ষ্মা রোগের ক্ষেত্রে এন্টিবায়োটিক resistance এর কিছু উল্লেখযোগ্য কারণ রয়েছে:
১. যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি এবং প্রতিদিন কোর্স মেনে ঔষধ খাওয়ার প্রতি কম গুরুত্ব দেয়া ও সদিচ্ছার অভাব।
২. Drug susceptibility test করার পূর্বেই ঔষধ শুরু করা।
৩. অন্য রোগের জন্য যক্ষ্মা সংক্রান্ত এই এন্টিবায়োটিকগুলো যথাযথভাবে না খাওয়ার পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতা।
৪. জেনেটিক কারণ: বংশানুক্রমে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোতে কিছু জেনেটিক মিউটেশন এর হার বেশি যা এন্টিবায়োটিক resistance এর জন্য দায়ী, যেমন: rpoB জিনে মিউটেশন Rifampicin resistance এর জন্য দায়ী।
৫. পরিবেশগত কারণ: বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর পরিবেশের বিভিন্ন প্রভাবকও Mycobacterium tuberculosis এর growth এর জন্য সহায়ক বলে ধারণা করা হয়, যেমন: তাপমাত্রা, আর্দ্রতা।
প্রতিবেদনটির তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে “Prevalence of Antibiotic-Resistant Pulmonary Tuberculosis in Bangladesh: A Systematic Review and Meta-Analysis” যা পাওয়া যাবে এই লিংক এ।