শিশু মানেই আগামীর নেতৃত্ব; হোক সে ছেলে অথবা মেয়ে! বিশ্বব্যাপী প্রাপ্ত বয়স্কদের স্তন ক্যান্সার সম্পর্কিত সচেতনতা দ্রুত আকারে ছড়িয়ে পড়লেও শিশুদের মাঝে এই রোগটির সংক্রামণ সাম্প্রতিক সময়ে ধরা পড়েছে! এবং শিশুদের ব্রেস্ট ক্যান্সার থেকে রক্ষা করতে প্রয়োজন অভিভাবকদের সামান্য একটু নিবিড় পর্যবেক্ষণ!
শিশুদের স্তন ক্যান্সার:
স্তন ক্যান্সার হলো এক প্রকার ব্যাধি যা স্তনের মধ্যে ম্যালিগন্যান্ট (ক্যান্সার) কোষের কারণে হয়ে থাকে। এটা মেয়ে এবং ছেলে উভয়েরই হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে!
প্রাথমিক অবস্থা:
অধিকাংশ সময়ই প্রথম অবস্থায় শিশুদের মাঝে ফ্রাইব্রোএডিনোমাস দেখা দেয়!
ফ্রাইব্রোএডিনোমাস: ফ্রাইব্রোএডিনোমাস হলো স্তনের এমন একটি পিন্ড/ দড়ির মতো অবস্থার উপস্থিতি যা সাধারণত কম বিপদজ্জনক এবং ক্যান্সার সৃষ্টিকারী নয়। এটি গ্র্যাল্ডুলার টিস্যু এবং যোজক টিস্যু দ্বারা গঠিত। এটি সাধারণত স্তনের বাহিরের দিকে উপরিভাগে অনুভব হয়, ২০ থেকে ৫০ এর মহিলারা অধিক ঝুঁকিতে থাকলেও সব বয়সী মহিলাদের এই উপসর্গ দেখা যায়! ফ্রাইব্রোএডিনোমাস ফাইলোডেস এ পরিনত হলে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
সম্প্রতি শিশুদের মধ্যেও এর উপস্থিতি পাওয়া গেছে তবে বাংলাদেশে এটার কোনো রেকর্ড এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায় নি।
ফাইলোডেস: অস্বাভাবিক কোষ বিভাজনের ফলে যে টিউমার সৃষ্টি হয় সেটি পরবর্তীতে ক্যান্সার এ পরিনত হওয়ার জন্য দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে, এ অবস্থাকেই ফাইলোডেস বলা হয়। ফাইলোডেস মূলত ফ্রাইব্রোএডিনোমাসের বিশেষ রুপ (ম্যালিগন্যান্ট রূপ)।
তবে আশার বিষয় হলো শতকরা ৭৫% মহিলাই ফ্রাইব্রোএডিনোমাস অবস্থায় সুস্থ হয়ে গেছেন ও স্তন ক্যান্সার হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছেন। প্রতি ৪ জনে ১ জন দূর্ভাগা যাদের ফ্রাইব্রোএডিনোমাস পরবর্তীতে ফাইলোডেস এ পরিনত হয়েছে!
উল্লেখ্য যে ফ্রাইব্রোএডিনোমাস কোনো ক্যান্সার নয়! এটি প্রাথমিক একটা লক্ষণ মাত্র! এটা হলেই কারো স্তন ক্যান্সার হয়েছে বলে মনে করা মোটেও ঠিক নয়।
কিন্তু খুবই বিরল কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, এই ফ্রাইব্রোএডিনোমাস পরবর্তীতে বৃহৎ ফাইলোডেস টিউমারে পরিণত হয়ে দ্রুতই বাড়তে থাকে। যা পরবর্তীতে ব্রেস্ট ক্যান্সার এ রুপান্তরিত হয়।
শিশুদের মধ্যে স্তন ক্যান্সার বিকাশের তিনটি মাধ্যম শনাক্ত করা হয়েছে,
পর্যায় ০১ঃ টিস্যু
পর্যায় ০২ঃ লসিকাতন্ত্র
পর্যায় ০৩ঃ রক্ত
এই তিনটি পর্যায়ের মাধ্যমে ক্যান্সার দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
শিশুদের কেনো হয় স্তন ক্যান্সার:
এই ক্যান্সারের শুরুটা দেহের অন্য কোনো স্থান থেকেও হতে পারে, যেমন কোনো শিশুর যদি লিউকেমিয়া থাকে, সেক্ষেত্রে ক্যান্সার কোষটি রক্ত বা লসিকার মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে স্তনের আশেপাশের স্থানে এসে পৌঁছে ও পরবর্তীতে স্তন ক্যান্সার রুপে বাড়তে পারে। আবার অন্যভাবে কারো যদি স্তন ক্যান্সারের কোষ প্রবাহিত হয়ে হাড়ে পৌঁছায় ও সেখানে ক্যান্সার হিসেবে বাড়ে, তবে সেটিকে প্রাথমিকভাবে ‘বোন ম্যারো ক্যান্সার’ মনে হতে পারে। এই প্রক্রিয়াটি মেটাস্ট্যাসিস নামে পরিচিত। প্রাথমিকভাবে এইসকল ক্ষেত্রে বুঝা যায়না ক্যান্সার কোষের মূল সৃষ্টি কোথায়, তবে নিয়মিত ডায়াগনোসিস এর মাধ্যমে পরবর্তীতে তা জানা যায়। যে সকল বাচ্চাদের ছোটবেলা থেকে অন্য কোনো ক্যান্সার কোষের অস্তিত্ব শরীরে ছিলো তাদের এই রোগ হওয়ার সম্ভবনা বেশি!
যেমন –
১. লিউকেমিয়া
২. লিম্পোমা
৩. নরম যোজক সারকোমা (Soft tissue Sarcoma).
শারীরিক গঠন ভেদে এই লক্ষণগুলো ভিন্নও হতে পারে।
কোন ধরনের বাচ্চাদের স্তন ক্যান্সারের অধিক ঝুঁকি রয়েছে:
১. যে সকল বাচ্চাদের পূর্ব থেকেই কোনো না ক্যান্সারের লক্ষণ বা উপসর্গ ছিলো।
২. যে সকল বাচ্চাদের মায়ের স্তন ক্যান্সার ছিলো। এটা একটি জেনেটিক ব্যাধি বলে প্রমাণিত। BRCA1 & BRCA2 জিনদ্বয়ের কারণে স্তন ক্যান্সার হয়ে থাকে।
৩. যাদের ইতিপূর্বে অন্য কোনো ক্যান্সার থেকে মুক্তি পেতে রেডিয়েশন থেরাপি দেওয়া হয়েছে তারও অধিক ঝুঁকিতে থাকে।
লক্ষণ সমুহ:
১. স্তনের নিচে কিংবা এর পাশে লাম্পস (স্তনের মধ্যে এক ধরনের চাকা) দেখা যাওয়া!
২. স্তনের লাম্পস ভিতরের দিকে প্রবেশ করা
৩. স্তনের ত্বকে ডিম্পল (কমলা রং ধারণ করা) দেখা যাওয়া
৪. লাল হয়ে যাওয়া
৫. স্তনবৃন্ত থেকে রক্ত বের হওয়া
অনেক ক্ষেত্রে এই সবগুলো লক্ষণ নাও দেখা যেতে পারে, ক্ষেত্রবিশেষে লক্ষণ গুলো ভিন্নও হতে পারে যেহেতু বিষয়টি এখনোও গবেষণাধীন!
রোগ নির্ণয় পদ্ধতি:
১. পারিবারিক ইতিহাস (জেনেটিক্যালি ট্রান্সমিডেট হওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে): এটি জেনেটিক্যালি মায়ের শরীর থেকে সন্তানের শরীরে স্থানান্তরিত হতে পারে! অর্থাৎ মায়ের দেহ থেকে BRCA1 & BRCA2 জিন দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার সম্ভবনা আছে!
২. শারীরিক পরীক্ষা (এ ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধিকালের লক্ষণ গুলো খুব ভালো করে জানা থাকা প্রয়োজন): প্রাথমিকভাবে সুস্থ স্তন এবং রোগাক্রান্ত স্তন সম্পর্কে মায়েদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো যেতে পারে। উল্লেখিত কোনো লক্ষণ আছে কি না তা বাসায়ই পরীক্ষা করে দেখতে পারেন সকল মা।
৩. এমআরআই (MRI): এই প্রক্রিয়া nuclear magnetic resonance imaging (NMRI) নামেও পরিচিত।
৪. আল্ট্রাসাউন্ড (Ultrasound): সনোগ্রাম পদ্ধতিতে এই ক্ষেত্রে ক্যান্সার কোষ চিহ্নিত করা হয়।
৫. পিইটি স্ক্যান (PET Scan): রক্তের মাধ্যমে দেহে রেডিওএক্টিভ গ্লুকোজ প্রবাহিত করে এই পরীক্ষাটি করা হয়। দেহের কোষের মেটাবলিজম হার থেকে এখানে ক্যান্সার কোষ সনাক্ত করা যায়।
৬. স্তনের এক্সরে (X-ray of the chest)
৭. বায়োপসি (Biopsy): সম্ভাব্য সংক্রান্ত স্থান থেকে কোষ নিয়ে ল্যাবে পর্যবেক্ষণ করে প্যাথলজিক্যাল রিপোর্ট তৈরি করা হয়।
৮. ম্যামোগ্রাফি (Mammography): ম্যামোগ্রাফি হলো বিশেষ ধরনের এক্স রে, যা ম্যামোগ্রাফি যন্ত্রের দুই প্লেটের মাঝে রেখে করা হয়। এটা দ্বারা স্তনের অস্বাভাবিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা হয় এবং চাকা অথবা পিন্ডের উপস্থিতি যাচাই করা হয়!
অনেক সময় ক্যালসিফিকেশন টেস্টও করা হয়। ক্যালসিয়াম দানার উপস্থিতি, বিন্যাস, ধরণ দেখেও ক্যান্সার কোষ শনাক্ত করা হয়।
চিকিৎসা:
সবসময় মনে রাখা উচিত “Prevention is better than Cure”
১. ফ্রাইব্রোএডিনোমাস হলে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রেখে দেখতে হবে সেটা ফাইলোডেস এ পরিণত হয়েছে কি না, যদি হয় তাহলে টিউমারটি স্তনের যে অংশে হয়েছে শুধু সে অংশটুকু সার্জারি করে টিউমার সরিয়ে ফেলতে হবে।
২. রেডিয়েশন থেরাপি।
৩. ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি প্রতিহত করা।
বিশেষ সর্তকতাঃ বর্তমান সময়ে কিছু মানুষ অনলাইনে চিকিৎসা পরামর্শ দেখে নিজে নিজে চিকিৎসা নিতে শুরু করে দেয়, এ ধরনের চিকিৎসা খুবই বিপজ্জনক, তাই এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকা শুধু উত্তম নয় বরং অতি উত্তম! ক্যান্সার আদতেই একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সেনসেটিভ ব্যধি, তাই এর সকল পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণও বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের সাথে পরামর্শ করেই হওয়া প্রয়োজন। যে কোনো ধরণের ঝুঁকি এড়াতে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। অভিভাবকদের সচেতনায় রক্ষা পেয়ে যাক আগামীর সূর্য গুলো।
তথ্যসূত্রঃ হেলথলাইন, ক্যান্সার.গভ