আমি ডাক্তারও নই, বিজ্ঞানী বা গবেষকও নই৷ কিন্তু সাধারণ বিজ্ঞান এর ছাত্র এর দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রতিবেদনে উত্থাপিত দাবি নিয়ে কিছু প্রশ্ন তুলতে চাই
এই প্রতিবেদনটিতে দাবি করা হচ্ছে, ইথানল বাষ্প নিঃশ্বাসের সঙ্গে নিলে করোনা ঠেকানো যাবে৷ প্রতিবেদন এবং এরপর মাইক্রোবায়োলজিস্ট ড. মো. আলিমুল ইসলামের লাইভ প্রশ্নোত্তরও রয়েছে৷
* প্রতিবেদনের ভিডিওতে ক্যাপশন দেয়া হয়েছে ইথানলে দূর হবে করোনা ৷ এটা নতুন কোনো আবিষ্কার না৷ হ্যান্ড স্যানিটাইজার এজন্যই ব্যবহার করতে বলা হয়৷ আবার প্রতিবেদনের শিরোনামে বলা হচ্ছে ইথানলে সারবে কোভিড-১৯ ভাইরাস৷
কোভিড-১৯ ভাইরাস বলে কিছু নেই৷ ভাইরাসটির নাম শুরুতে ছিল নভেল করোনা ভাইরাস, পরে বিজ্ঞানীরা সেটির নাম দিয়েছেন সিভিয়ার একিউট রেসপায়রেটরি সিনড্রোম করোনা ভাইরাস- টু, সংক্ষেপে সার্স কভ-টু৷ আর করোনা ভাইরাস ডিজিজ- ২০১৯ হচ্ছে সার্স কভ-টু ভাইরাসের সংক্রমণে যে রোগ হয়, তার নাম, সংক্ষেপে কভিড-১৯৷
* প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত মুরগির ওপর গবেষণায় নাকি এটা প্রমাণ হয়েছে৷ অথচ, প্রতিবেদনের পর লাইভে এসে প্রথমেই ড. আলিমুল জানালেন উনি মুরগির ওপর গবেষণা চালাননি৷
* তাহলে গবেষণাটা কী? ড. আলিমুল মুরগির শরীর থেকে করোনা ভাইরাস বের করে ল্যাবে ইথানল প্রয়োগ করে দেখেছেন ভাইরাস মরে গেছে৷ কিন্তু এটার জন্য নতুন গবেষণা কেনো দরকার? ৬০% অ্যালকোহলে করোনা মারা যায়, এ তথ্য তো এতোদিনে সবার জানা থাকার কথা৷
* ইথানলের বাষ্প নিঃশ্বাসের সঙ্গে নিলে ফুসফুস বা শ্বাসতন্ত্রের ভাইরাস মারা যায় কি না, এ বিষয়ে ড. আলিমুলের কোনো গবেষণা চালানোর কোনো তথ্য আমি অন্তত ড. আলিমুলের মুখ থেকে শুনতে পাইনি৷ তাহলে এই প্রতিবেদনটা কী নিয়ে!
* ড. আলিমুলের দাবি, তিনি নিজে এবং তার আট ছাত্র ইথানল বাষ্প নিয়ে উপকার পেয়েছেন৷ কিন্তু সেটা কিসের উপকার? সর্দি, কাশি, গলা ও মাথা ব্যথা৷
* ড. আলিমুল মুরগির ওপরও এ পরীক্ষা চালাননি, মানুষের ওপরও না৷ ফুসফুস ও শ্বাসতন্ত্রে ইথানল বাষ্পের প্রভাব পরীক্ষা না করেই লকডাউনে থাকা মানুষেরা এটা ব্যবহার করতে পারেন বলে যে পরামর্শ দিয়েছেন, তা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে৷ ইথানল বাষ্প ফুসফুস এবং শরীরে ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে৷
এ নিয়ে প্রচুর গবেষণা অনলাইনেই পাওয়া যায়৷ এখন তার কথা শুনে দেশের মানুষ অ্যালকোহল বাষ্প ইনহেল করা শুরু করলে কী বিপদ হতে পারে, টের পাচ্ছেন?
* মানুষের ওপর পরীক্ষা ছাড়াই দিনে কয়বার কয়দিন ব্যবহার করা যাবে, সে তথ্যও প্রতিবেদনে দিয়ে দেয়া হলো৷ কী ভয়ঙ্কর! ইথানলে অ্যালার্জি নাই যাদের, যাদের হাঁপানি নাই, যাদের শ্বাসকষ্ট নাই, তারা এটা ব্যবহার করতে পারবেন বলে ড. আলিমুল দাবি করছেন৷ একটা লোক জানবে কিভাবে তার ইথানলে অ্যালার্জি আছে কিনা?
আর যে মানুষগুলোকে ড. আলিমুল বাদ দিয়েছেন, তারাই তো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন করোনা সংক্রমণে৷ যার কিছুই নাই, তার রোগ প্রতিরোধের স্বাবাবিক ক্ষমতাই করোনা প্রতিরোধে ব্যাপক মাত্রায় সক্ষম৷
* বারবার ড. আলিমুলের কথায় জাপানের একটি গবেষণার তথ্য উঠে আসছে৷ ওই গবেষণাতেও রেসপায়রেটরি ট্র্যাক্টের কথাই বলা হয়েছে৷ ইথানল আপনার শরীরে করোনা ভাইরাস মেরে ফেলবে, এমন দাবি কোথাও করা হয়নি৷ খেয়াল করতে হবে, শ্বাসতন্ত্র মানে পুরো শরীর না৷ আর হুবহু জাপানের গবেষণার তথ্যই যদি আওড়াতে হয়, তাহলে সেটা নিয়ে প্রতিবেদন করলেই হয়৷ ড. আলিমুলের ফাইন্ডিংসটা কী!
* তারপরও গবেষণা হতেই পারে৷ এর যদি আসলেই কোনো ভিত্তি থেকে থাকে এবং উপকার পাওয়া যায়, তাহলে তো সবার জন্যই ভালো৷ কিন্তু পৃথিবীজুড়ে গবেষকেরা আগে নিজেরা গবেষণা চালিয়ে প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে দাবি জানান এবং আরো গবেষণার জন্য অর্থ ও সময় বরাদ্দ চান৷ ড. আলিমুলের ক্ষেত্রে অন্তত এই প্রতিবেদন ও লাইভে সাক্ষাৎকারে আমি কোনো প্রাথমিক প্রমাণের তথ্যও পেলাম না৷
এখন আমি যদি কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়া দাবি করি থানকুনি পাতা খেয়ে আমি ও আমার ৮ বন্ধু উপকার পেয়েছি, তাহলে আমাকেও প্রতিবেদনে ফলাও করে প্রচার করা হবে? আমাকেও গবেষণার জন্য বরাদ্দ দেয়া হবে?
ড. আলিমুল আমার চেয়ে অনেক অভিজ্ঞ এবং ভাইরাস বিষয়ে নিঃসন্দেহে আমার চেয়ে কোটি গুণ বেশি জ্ঞান রাখেন৷ কিন্তু অন্তত এই প্রশ্নটা তো তোলা উচিত ছিল, কোন প্রাথমিক প্রমাণের ভিত্তিতে তিনি এই দাবিটা করছেন?
কেউ তথ্য ও যুক্তি দিয়ে আমার ভুল ধরিয়ে দিলে খুবই খুশি হবো৷