নিদ্রাহীনতা বর্তমানে একটি স্বাভাবিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। নিদ্রাহীনতাকে বিজ্ঞানীরা দুইটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। এগুলো হলো- (১) প্রাইমারি ইনসমনিয়া ও (২) সেকেন্ডারি ইনসমনিয়া।
প্রাইমারি ইনসমনিয়া বংশগত কারণে হয়ে থাকে। আর সেকেন্ডারি ইনসমনিয়া হয়ে থাকে নানা শারীরিক ও মানসিক কারণে। এরমধ্যে মাদকদ্রব্যের নেশা একটি বড় কারণ।
বিভিন্নপ্রকার মাদক গ্রহণের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে আমরা অনেকেই অবগত আছি। তবে একটি ক্ষতিকর দিক প্রায়শই চোখের আড়ালে চলে যায়। সেটি হলো অনিদ্রাজনিত সমস্যা। আমরা মনে করি মাদকাসক্ত ব্যক্তি হয়তো বেশ ভালোভাবেই ঘুমিয়ে থাকেন। কিন্তু ব্যাপারটা তেমন না।
নেশায় আসক্ত ব্যক্তির ঘুমের সমস্যা ব্যক্তিকে বিপর্যস্ত করে তুলে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, নেশায় আসক্তদের শতকরা ৪৯ ভাগ ঘুমের সমস্যা বা ইনসমনিয়াতে আক্রান্ত হয়।
এবার আসা যাক ঘুমের কার্যকলাপ নিয়ে।
গবেষকদের মতে, ঘুম হলো মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রিত এক প্রতিবর্ত ক্রিয়া। আমাদের মস্তিষ্কের ‘হাইপোথ্যালামাস’ অংশে রয়েছে স্লিপ সুইচ। এই সুইচটি ঘুম নিয়ন্ত্রণ করে । এটা আসলে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসের সামনের অংশের একগুচ্ছ বিশেষ ধরণের সেল বা কোষ। যে অঞ্চলটাকে ব্রেইন অব দ্য ব্রেইনও বলা হয়। এই স্নায়ু কোষগুলো থেকে এক ধরণের রাসায়নিক বা কেমিক্যাল সংকেত হাইপোথ্যালামাসের পেছনে বিশেষ আরেকটি অঞ্চলে পৌঁছালেই মানুষের ঘুম পায়। আবার পিছন থেকে উল্টোপথে এই সংকেত হাইপোথ্যালামাসের সামনে পৌঁছালে মানুষ জেগে উঠে। এই স্লিপ সুইচ আবার দেহের বায়োলজিক্যাল ক্লকের সাথে তাল রেখে চলে।
আমরা অনেকেই সার্কাডিয়ান রিদম এর সাথে পরিচিত। হয়তো অনেকেই বিস্তারিত জানিনা। কিন্তু নাম অন্তত শুনেছি। এই সার্কাডিয়ান রিদম হচ্ছে জৈবিক ঘড়ি। একজন মানুষ কতক্ষণ ঘুমাবে কিংবা জেগে থাকবে, তার একটা নির্দিষ্ট সীমারেখা বেঁধে দিয়েছে এই জৈবিক ঘড়ি। বলা যায়, আমাদেরকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করেছে এটি।
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ ক্লিফোর্ড সাপারের নেতৃত্বাধীন একদল গবেষকের গবেষণা থেকে এসব তথ্য উঠে আসে। তাদের গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় ২০০৭ সালে। তবে, এই গবেষকদল যেটিকে ‘ফ্লিপ-ফ্লপ সুইচ’ বলে অভিহিত করেছেন, মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসের সেই সুইচ কখন অন অফ হয়, সেই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য এখনও কোনো বিজ্ঞানী মহল সুনির্দিষ্টভাবে দিতে পারেননি।
তবে একটি বিষয়ে মনোবিজ্ঞানী এবং স্নায়ুবিজ্ঞানীরা একমত যে, কোনো কারণে মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহে ঘাটতি পড়লে মানুষের ঘুম পায়।
এখন আসি নিদ্রাহীনতা বা ইনসমনিয়া বিষয়ে।
প্রাইমারি ইনসমনিয়া হয় বংশগত কারণে, পূর্বপুরুষের মধ্যে এই রোগটি থাকলে তা পরবর্তী বংশধরেও বাহিত হয়। আর সেকেন্ডারি ইনসমনিয়ার কারণ শারীরিক ও মানসিক। এরমধ্যে একটি হলো মাদকদ্রব্যের নেশা।
এই মাদকদ্রব্যের মধ্যে রয়েছে ক্যাফেইনযুক্ত মেডিসিন, কোকেন, নিকোটিন, মেথাফেটামিনস ইত্যাদি। । অনেকে আবার ঘুম আনয়নের জন্য রাতে মাদকদ্রব্য সেবন করেন। তারা ভাবেন এতে করে সহজেই ঘুম চলে আসবে। কিন্তু, এই ধরণের কাজ মন ও মস্তিষ্কের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। অনেকে আবার ঘুম না এলে ঘুমের ওষুধ সেবন করেন। এ ধরণের ওষুধ বা মাদকে আসক্তির ফলে কিডনি, লিভারে সমস্যা দেখা দিতে পারে। আবার অনেকেই মদ্যপান করেন। এটিও কিন্তু স্বাস্থ্যকে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে।
এভাবে বিভিন্নপ্রকার মাদক সেবন ধ্বংসই ডেকে আনে, কিন্তু ঘুম আনে না। মূলত, শৃঙ্খলা আনয়নের মাধ্যমে পরিপূর্ণ জীবনধারণই হতে পারে এর উত্কৃষ্ট সমাধান।