ঋতুস্রাব/পিরিয়ড যৌবনপ্রাপ্তির পর মেয়েদের জীবনে একটি নিয়মিত ঘটনা। মেয়েদের জরায়ু যে পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায় এবং প্রতিমাসে হরমোনের প্রভাবে মেয়েদের যোনিপথ দিয়ে যে রক্ত ও জরায়ু নিঃসৃত তরল পদার্থ বের হয়ে আসে তাকে পিরিয়ড বা ঋতুস্রাব বলে৷ (পিরিয়ড সমস্যা)
ঋতুস্রাব বা পিরিয়ডের মূলত ফেজ ৩ টিঃ
১) মেন্সট্রুয়াল ফেজ- ৪ দিন স্থায়ী হয় (৪-৭ দিন)
২) প্রলিফারেটিভ ফেজ- ১০ দিন স্থায়ী হয় (৮-১০ দিন)
৩) সেক্রেটরি ফেজ- ১৪ দিন স্থায়ী হয় (১০-১৪ দিন)
পিরিয়ডের সময় কিছুটা ব্যথা, অস্বস্তি, ক্র্যাম্পিং (মাংস জমাট বেধে ব্যথা হওয়া) ইত্যাদি স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু প্রতিবার পিরিয়ডের সময় অত্যাধিক ব্যথায় কোনো মেয়ের স্বাভাবিক জীবনধারায় সমস্যার সৃষ্টি হয়। যেমনঃ স্কুল, কলেজ বা অফিসে যাওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া, দৈনন্দিন কাজের রুটিনে সমস্যা হওয়া ইত্যাদি। যার ফলে এটি মোটেও আর স্বাভাবিক কোনো ঘটনা বা হেলাফেলার বিষয় থাকেনা। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায়, যন্ত্রণাদায়ক ঋতুস্রাবকে ডিস্মেনোরিয়া (Dysmenorrhea) বলে। একে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়-
১.প্রাইমারি ডিস্মেনোরিয়া এবং
২.সেকেন্ডারি ডিস্মেনোরিয়া।
কোনো নারী যদি ঠিক ঋতুস্রাবের পূর্বে এবং ঋতুস্রাব চলাকালীন সময়ে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করেন কিন্তু এছাড়া বাকি সময় সুস্থই থাকেন, তাকে প্রাইমারি ডিস্মেনোরিয়া বলে। আর যেসব নারীদের স্বাভাবিকভাবে পিরিয়ড শুরু হয়ে পরবর্তীতে যন্ত্রণাদায়ক হয়ে যায়, তাদের ক্ষেত্রে একে বলা হয় সেকেন্ডারি ডিস্মেনোরিয়া। এই সমস্যাটা সাধারণত জরায়ুকে এবং অন্যান্য শ্রোনীদেশীয় (Pelvic) বা তলপেটের অঙ্গগুলোর উপর প্রভাব বিস্তারকারী সমস্যার সাথে যুক্ত।
কারা আছেন অধিক ঝুঁকির মাঝে?
ঋতুস্রাব প্রচন্ড যন্ত্রণাদায়ক হওয়ার নির্দিষ্ট কোনো কারণ নাও থাকতে পারে। তবে কিছু কিছু নারী এই যন্ত্রণাদায়ক ঋতুচক্রের জন্য বিশেষভাবে ঝুঁকির মাঝে থাকেন। যারা এই ঝুঁকির ভেতর থাকেন তারা হলেন-
* যাদের বয়স ২০ বছরের চাইতে কম।
*যাদের পরিবারে যন্ত্রণাদায়ক ঋতুস্রাবের ইতিহাস আছে, অর্থাৎ মা, খালা, ফুফু, দাদু, নানু- এদের কারোর এই সমস্যা ছিলো বা আছে।
*যারা ধূমপান করেন
*যাদের প্রতিবার পিরিয়ডের সময় অনেক বেশি রক্তক্ষরণ হয়।
*যাদের পিরিয়ড অনিয়মিত।
*যাদের কখনও কোনো বাচ্চা হয়নি।
*যারা সঠিক বয়সের আগেই বয়ঃসন্ধি লাভ করেন, অর্থাৎ ১১ বছরের আগেই যাদের পিরিয়ড আরম্ভ হয়ে যায়।
নারীদেহে প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন নামক হরমোন জরায়ুর মাংসপেশির সংকোচন ঘটায়, যাতে করে জরায়ু থেকে প্রতিমাসে রক্তজালিকাগুলি বের হয়ে আসে। এই সংকোচন যন্ত্রণা এবং ফুলে ওঠার (Inflammation) কারণ হতে পারে। যে নারীর দেহে যত উচ্চমাত্রায় প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন ক্ষরিত হয়, তিনি পিরিয়ডের সময় তত উচ্চমাত্রায় যন্ত্রণা এবং ক্র্যাম্পিং অনুভব করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেকেন্ডারি ডিস্মেনোরিয়ায়ও কিছু রোগের কারণে যন্ত্রণাদায়ক পিরিয়ড হয়ে থাকে-
*পিরিয়ড পূর্ববর্তী অসুস্থতা (Premenstrual Syndrome সংক্ষেপে PMS)
*Endometrosis (একটি যন্ত্রণাদায়ক শারীরিক অসুস্থতা, যেখানে জরায়ুর ভেতরের রক্তজালিকার কোষগুলি দেহের অন্য অংশে জন্মাতে শুরু করে।)
*জরায়ুতে Fibroid (একধরণের টিউমার যা পরবর্তিতে কখনো ক্যান্সারে রূপ নেয়) জন্মানো।
*শ্রোণিদেশীয় স্থান ফুলে ওঠা রোগ (Pelvic inflammatory Disease), জরায়ু (Uterus), ডিম্বনালী (Fallopian tubes), অথবা ডিম্বাশয় (Overies) -এর সংক্রমণ, যা যৌনবাহিত রোগের (Sexually Transmitted Disease) কারণে প্রায়ই হয়ে থাকে।
*যৌনবাহিত রোগ।
*অ্যাডেনোমায়োসিস (Adenomyosis ), একটি বিরল অসুস্থতা যাতে, জরায়ুর ভেতরের নালীকাগুলো জরায়ু প্রাচীরের পেশীর অভ্যন্তরে জন্মায়।
*Cervical stenosis, আরেকটি বিরল অবস্থা যাতে সারভিক্স (জরায়ুমুখ) এতই ছোট হয় যে তা পিরিয়ডের প্রবাহকে ধীর করে দেয়।
*কিছু কিছু ধরণের গর্ভনিরোধক, বিশেষ করে জরায়ুর ভেতর তামা নির্মিত যেসব নিরোধক (Intrauterine devices বা সংক্ষেপে IUD) ব্যবহার করা হয়, যা পিরিয়ডের সময় অতিরিক্ত ব্যথার সৃষ্টি করে থাকে।
পিরিয়ডে রক্তপাতের পরিমাণ:
প্রতি পিরিয়ডে এক কাপেরও কম রক্ত নিঃসৃত হয়। সাধারণত প্রথম দুই দিন বেশি রক্ত নিঃসৃত হয়। একটি জরিপের বলা হয়, প্রতি মাসে কয়েক চামচ থেকে বড়জোর এক কাপ পরিমাণ রক্ত বের হয় শরীর থেকে। এখন অনেকেরই হয়তো মনে হতে পারে তার রক্তপাত উপরের উল্লেখিত পরিমাণ থেকে বেশি।
এর কারণ হল ঋতুস্রাবের সময় স্ত্রী জননাঙ্গ থেকে নিঃসৃত তরল শুধু রক্ত নয়, এর সঙ্গে থাকে ‘ইউটেরাইন টিস্যু’, ‘এন্ডোমেট্রিয়াল সেলস’, জমাট বাঁধা রক্ত ইত্যাদি যা একত্রিত হয়ে পরিমাণ অনেকটা বাড়িয়ে দেয়। আর একারণেই মনে হয় প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। যদি ব্যবহার শুরু করার ২ ঘণ্টার কম সময়ে প্যাড সম্পূর্ণ ভিজে যায় তাহলে বুঝতে হবে এটা স্বাভাবিক নয়।
জরায়ুর মুখে ক্যান্সার, টিউমার, ওভারিয়ান সিস্ট ইত্যাদি কারণে পিরিয়ডে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে। তাই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলে লজ্জা না পেয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
ঋতুস্রাবের তরলের মাত্রা যদি ৮০ মি.লি.লিটারের বেশি হয় তাহলে তাকে ‘হেভি পিরিয়ড’ হিসেবে ধরা হয়। এছাড়াও সাতদিনের বেশি সময় উল্লেখযোগ্য হারে রক্তক্ষরণ অব্যাহত থাকলে তাকেও ‘হেভি পিরিয়ড’ বলা যাবে।
অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের সাধারণ কিছু কারণ হলো ‘এন্ডোমেট্রিওসিস’, ‘কোয়াগুলেশন ডিজওর্ডার’, ‘ইউটেরাইন ফাইব্রোয়েডস’, ‘ইন্ট্রাইউটেরাইন ডিভাইস (আইইউডি), ‘পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (PCOS)’।
যাদের ধারণা তাদের ‘হেভি পিরিয়ড’ হচ্ছে তাদের উচিত হবে ঋতুস্রাব চক্রের হিসাব রাখা। সেখানে মাসিক চলাকালীন কয়দিন রক্তপাত হয়, দিনে কতবার ‘স্যানিটারি প্যাড’ পরিবর্তন করতে হয় ইত্যাদির হিসেব রাখতে হবে। ব্যথা হচ্ছে কিনা সেদিকেও তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে এবং ব্যথা হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
স্যানিটারি প্যাড বা ন্যাপকিন ব্যবহারের নিয়ম:
বাজারে এখন বিভিন্ন ব্র্যান্ড এর অনেক ধরনের স্যানিটারি ন্যাপকিন বা প্যাড পাওয়া যায়। যে ধরনেরই হোক না কেন তা কোনভাবেই দীর্ঘক্ষণ পরা উচিত নয়।পিরিয়ডের প্রথম দুই-তিন দিন একটু বেশী রক্তক্ষরণ হয়, তাই দুই ঘন্টা পরপর প্যাড পরীক্ষা করে দেখা উচিত। যদি প্যাড শুকনো না থাকে অর্থাৎ উপরের অংশে রক্তের পরিমাণ বেশি দেখা যায় তবে সাথে সাথে তা চেঞ্জ করা উচিত এবং কোনভাবেই চার ঘণ্টার বেশি একটি প্যাড পরা উচিত নয়।
কিন্তু চতুর্থ বা পঞ্চম দিন থেকে রক্তস্রাবের পরিমাণ কিছুটা কমে আসে। এ সময় অনেকেই আছেন যারা একটি স্যানিটারি ন্যাপকিন কম রক্তপাত হচ্ছে ভেবে দীর্ঘসময় ধরে ব্যবহার করেন। ফলে সেই রক্ত দ্রুত শুকিয়ে সেখানে জীবানুর আক্রমণ হয় যা যোনিপথের সংস্পর্শে এসে বিভিন্ন চুলকানি, ফোঁড়া, যৌনাঙ্গের নানান রকম অসুখ ও ফাঙ্গাল ইনফেকশন ইত্যাদি সৃষ্টি করে।
মেয়েরা চব্বিশ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে স্যানিটারি ন্যাপকিন পরে থাকে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের কারণে। কিন্তু এ ধরনের প্যাড দীর্ঘসময় শুকনো রাখার জন্য ‘সেলুলোজ জেল’ নামক উপাদান ব্যবহার করা হয় যা জরায়ুমুখের ক্যান্সারের জন্য দায়ী। প্যাড কিংবা কাপড় যাই ব্যবহার করুন না কেনো সেটি ব্যবহারের পূর্বে অবশ্যই ভালোভাবে চেক করে নিবেন সেখানে কোনো ময়লা বা পোকামাকড় কিংবা অন্যকিছু আছে কিনা। আর কাপড় ব্যবহার করলে অবশ্যই তা পরিষ্কার এবং জীবাণুমুক্ত করে ব্যবহার করবেন। কাপড় ব্যবহারের ক্ষেত্রে নরম, পাতলা কাপড় ব্যবহার করবেন।
পিরিয়ডকালীন সময়ের জন্য কিছু টিপসঃ
• হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করুন সবসময়। পছন্দের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন, টেনশনমুক্ত থাকুন।
• পিরিয়ডের সময় চুপচাপ শুয়ে বসে না থেকে হালকা কিছু ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করুন। রক্ত প্রবাহ নিয়মিত করতে ও ব্যাথা কমাতে এটি খুবই উপকারী। অনেকের এসময় শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা অনুভব হয় এক্ষেত্রে ব্যায়াম কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে।
• এ সময় তলপেটে হালকা ব্যথা হওয়া খুবই স্বাভাবিক। এই ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে শুরুতেই পেইনকিলার খাওয়া উচিত নয়। হট ওয়াটার ব্যাগে গরম পানি নিয়ে তলপেটে হালকা সেঁক দিলে ব্যথা অনেকটাই কমে যায়।
• ভারী কাজ বা ভারী ব্যায়াম থেকে বিরত থাকতে হবে।
• প্রচুর পরিমাণে পানি, ফলের জুস ও শরবত জাতীয় পানীয় খেতে যা শরীরকে ফ্রেশ রাখতে সাহায্য করে।
• শরীরে আয়রনের ঘাটতি পূরণ করতে এ সময় খাদ্যতালিকায় বাড়তি সবুজ শাকসবজি, মাছ, মাংস, কলিজা ইত্যাদি রাখতে হবে।
• বিভিন্ন রকম ফলমূল যেমন: কলা, পেয়ারা, আমড়া, লেবু, জলপাই, পেপে, আনারস ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি সরবরাহ করে, যা আয়রনের শোষণ ও কার্যক্ষমতা বাড়ায়।
• ক্যাফেইন থেকে অর্থাৎ চা-কফি থেকে দূরে থাকাই ভালো এসময়। ক্যাফেইন রক্ত চলাচলকারী শিরা-উপশিরাকে সংকুচিত করে দেয়। এত ব্যথা বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে
• আদা,দারচিনি, কালোজিরা এসময় খুব উপকারী ব্যথা উপশমে।
• চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা উচিত।
• NSAID বা ননস্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি ওষুধগুলো পিরিয়ডের ব্যথা দূর করতে বেশি কার্যকরী। এসব ওষুধের মাঝে রয়েছে আইবোপ্রোফেন, ডাইক্লোফেনাক, কিটোরোলাক, অ্যাসপিরিন ইত্যাদি। এসব ওষুধ সাইক্লোঅক্সিজেনেজ নামের একটি এনজাইমকে আটকে দেয়, ফলে প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন কমে। প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন কমার কারণে ব্যথাও কমে আসে। তাই এরপর পিরিয়ডের ব্যথায় কোনো ওষুধ খেতে চাইলে নিশ্চিত হয়ে নিন তা NSAID ধরনের কি না।
এগুলো পড়তে ভুলবেন না !! |
• পিরিয়ড ক্র্যাম্প অনেকের খুব বেশি হয় এক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া জরুরি। যদিও এসবক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা কমই থাকে।
- অনেকসময় দেখা যায় মেয়েরা তাদের বিভিন্ন কাজের জন্য পিরিয়ড বন্ধ করতে কন্ট্রাসেপটিভ পিল গ্রহণ করে থাকে। এটা সবসময় করা উচিত না খুব ইমার্জেন্সি না হলে। জন্ম নিয়ন্ত্রক পিলগুলির পিরিয়ডের উপর সরাসরি প্রভাব আছে। এটি ঋতুচক্রকে হালকা করে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পিরিয়ড সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেয়। এছাড়াও এর আরও অনেক সাইড ইফেক্ট রয়েছে।
পিরিয়ড নিয়ে আমাদের সমাজে প্রচুর কুসংস্কার আছে যার কোনো ভিত্তি নেই। এটি নারীর সুস্থতার একটি প্রতীক এবং তার শরীরের একটি অংশ। তাই পিরিয়ড নিয়ে এখন আর কোন অজ্ঞতা, লজ্জা বা দ্বিধা মনের মধ্যে রাখা চলবে না। বয়ঃসন্ধির আগেই পরিবারের মেয়ে শিশুটির পাশাপাশি ছেলে শিশুটিকেও পিরিয়ড সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ধারণা দিতে হবে। এভাবেই আস্তে আস্তে সমাজ থেকে পিরিয়ড নিয়ে সকল ভুল ধারণা ও ট্যাবু দূর করা সম্ভব।
আরও পড়ুনঃ হাইমেন (স্বতীচ্ছদ) কখনই নারীর সতীত্ব নির্ধারণ করে না