মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গের কৃত্রিম অংশ প্রতিস্থাপন আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে বর্তমানে বেশ সহজ। তবে প্রতিস্থাপনযোগ্য কৃত্রিম অঙ্গগুলোর সংখ্যা এখনও অল্প কয়েকটি। দেহের অভ্যন্তরে থাকা সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর প্রায় কোনটিরই পুরোপুরি কৃত্রিম রূপ দেয়া সম্ভব হয়নি। ফলে গুরুত্বপূর্ণ সেই অঙ্গগুলোর অক্ষমতা দেখা দিলে সুস্থ ব্যক্তির টিস্যু প্রতিস্থাপন করতে হয় অথবা খুঁজতে হয় অন্য কোন বিকল্প।
এই ব্লগ পড়তে ভুলবেন না ! |
দেহের নিষ্কাশন ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ কিডনি বা বৃক্কের কথাই ধরা যাক। রেচনতন্ত্রের সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় এই অঙ্গের প্রধান কাজ দেহের বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশন করা। মূত্র উৎপাদন ও নিষ্কাশনের মাধ্যমে বৃক্ক নাইট্রোজেনঘটিত বিপাকীয় পদার্থ অপসারণ করে দেহকে সুস্থ রাখে। ফলে কোন কারণে বৃক্ক দুর্বল বা অকেজো হয়ে পড়লে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে উঠবে।
সাধারণত বৃক্ক অচল হলে দুটি উপায়ে এর প্রতিকার করা যায়। এরমধ্যে তুলনামূলক সহজ পদ্ধতি হচ্ছে ডায়ালাইসিস। এ পদ্ধতিতে রোগীর ধমনিতে একটি নালী যুক্ত করা হয়। পাম্পের সাহায্যে ধমনি থেকে সযত্নে রক্ত নালীর মাধ্যমে একটি মেশিনে প্রবেশ করানো হয়। এই কিডনি মেশিন রক্তকে পরিশ্রুত করতে থাকে। রক্ত পরিশুদ্ধ হবার পর আবার অন্য একটি নালীর মাধ্যমে রোগীর শিরায় প্রবেশ করে। পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে প্রায় ৬/৮ ঘণ্টা সময় প্রয়োজন হয়। কিডনি রোগীদের জন্য অপর পদ্ধতি বৃক্ক প্রতিস্থাপন। এক্ষেত্রে রোগীর টিস্যুর সাথে মিলে এবং একই রক্তের গ্রুপ সম্পন্ন সুস্থ ব্যক্তির কিডনি রোগীর দেহে স্থাপন করা হয়। দুটো কিডনি পুরোপুরি অকেজো হয়ে পড়লে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান বিজ্ঞানী ড. শুভ রায় গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চেষ্টা চালাচ্ছেন প্রতিস্থাপনযোগ্য কৃত্রিম কিডনি উদ্ভাবনের। তাঁর এ প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছে “The kidney project ” প্রকল্পে ড. শুভ রায়ের সাথে নেতৃত্বে ছিলেন নেফ্রোলজিস্ট উইলিয়াম ফিসেল।
বিশ্বব্যাপী প্রায় ২মিলিয়ন কিডনি রোগী রেচনতন্ত্র রোগের মারাত্নক পর্যায়ে রয়েছেন। কৃত্রিম কিডনি রোগীদের মারাত্মক পরিস্থিতি এড়িয়ে আবার তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সহায়তা করবে। ডায়ালাইসিস ও কিডনি প্রতিস্থাপন দুটোই অত্যন্ত ব্যয়বহুল চিকিৎসা ব্যবস্থা। কৃত্রিম কিডনি রোগীকে ডায়ালাইসিস জীবন থেকে মুক্তি দিবে। শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক কষ্টের অবসান ঘটাবে। এটি রোগীকে দীর্ঘকালীন কিডনি সুস্থতার নিশ্চয়তা প্রদান করবে।
কৃত্রিম কিডনি নামক এই ডিভাইসের প্রধান অংশ মূলত দুইটি। একটি বায়োরিয়েক্টর ও দ্বিতীয় উপাদান হেমোফিল্টার। এই দুটি অংশেই প্রাকৃতিক কিডনির কার্যক্রম যুক্ত করা হয়েছে। এরা রক্তকে পরিশুদ্ধ করবে, বিষাক্ত পদার্থ ও পুষ্টি উপাদান সংশ্লেষণ করবে, অতিরিক্ত জলকে মুত্রে পরিণত করবে ও মুত্রথলিতে নিয়ে যাবে। এছাড়াও অম্ল-ক্ষারের ভারসাম্য রক্ষা, হরমোন নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি কাজেও ডিভাইসটি ব্যবহার করা যাবে বলে গবেষকেরা আশা করছেন। ডায়ালাইসিস দ্বারা উক্ত কাজ গুলো করা অসম্ভব ছিল। ২০১৯ সালে ‘The Kidney Project‘ টিম জানায় তারা তেমন কোন প্রতিক্রিয়া ছাড়াই বড় প্রানীর মধ্যে বায়োরিয়েক্টরের সফল প্রতিস্থাপন করতে পেরেছেন। নিঃসন্দেহে হিউম্যান ট্রায়ালের জন্য এটি একটি মাইলফলক।
প্রকল্প হাতে নেবার পর থেকেই The Kidney Project সারা পৃথিবী থেকে কয়েক মিলিয়ন ডলারের অনুদান পেয়েছে এবং বেশকিছু পুরস্কার ও অর্থমূল্য জয় করেছে। শুধু তাই নয় আর্থিক পুরস্কারের পাশাপাশি দলটি যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন, মেডিকেয়ার এবং এইচএইচএস এর নেতৃস্থানীয় পর্যায়ের সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করবে। প্রধান লক্ষ্য থাকবে প্রযুক্তিটির যথাযথ বিকাশ ও কার্যকরিতা নিশ্চিত করা এবং এর বাণিজ্যিক পরিবেশ তৈরি করা।
ড. শুভ রায় এর সংক্ষিপ্ত জীবনী:
শুভ রায়ের জন্ম ১৯৬৯ সালে ঢাকায়। তাঁর পৈতৃক নিবাস চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি। বাবার পেশাগত কারণে ৫ বছর বয়সে সপরিবারে উগান্ডা চলে যান। তাঁর পিতা উগান্ডায় চিকিৎসক হিসেবে কাজ করতেন। উগান্ডা থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করার পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান এবং মাউন্ট ইউনিয়ন কলেজ (বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব মাউন্ট ইউনিয়ন) থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতে স্নাতক সম্পন্ন করেন। ১৯৯৫ সালে কেস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ ইউনিভার্সিটি থেকে তড়িৎ প্রকৌশল ও ফলিত পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর এবং ২০০১ সালে তড়িৎ প্রকৌশল ও কম্পিউটার বিজ্ঞানে পিএইচডি অর্জন করেন।
কর্ম জীবন : শুভ রায় এর কর্ম জীবন শুরু হয় ক্লীভল্যান্ড ক্লিনিকের বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে প্রজেক্ট স্টাফ হিসেবে। এরপর থেকে অদ্যাবধি তিনি ক্লীভল্যান্ডের এই ক্লিনিকেই বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করছেন। মাঝে বেশ কিছু সময় তিনি অধ্যাপনার দ্বায়িত্ব পালন করেন।
- The Kidney Project এর কাজ তাঁকে দুনিয়াজোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছে।