প্লেগ এবং মহামারী মানব ইতিহাসের সর্বত্রই তাদের ধ্বংসাত্মক রূপ বিস্তৃত করেছে, সেই সাথে ইতিহাসের গতিপথেরও করেছে পরিবর্তন।
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, মহামারীর প্রকোপ কখনো মানব সভ্যতাকে নতুন মোড় দিয়েছে, আবার কখনো পুরো সভ্যতাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। প্রাগৈতিহাসিক থেকে আধুনিক কাল, এই সময়ের মধ্যে ২০টি মহামারী তাদের ধ্বংসলীলা দেখিয়েছে।
(১) প্রাগৈতিহাসিক মহামারী: (আনুমানিক ৩০০০ খৃষ্ট পূর্বাব্দ)
প্রায় ৫০০০ বছর আগে, এক মহামারী চীনের একটি গ্রাম নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। নিহতদের লাশগুলো একটি বাড়ির ভিতরে জমা করা হয়েছিল যা পরে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। কোনো বয়সের মানুষ এই মহামারী থেকে রেহাই পায়নি, যার প্রমাণ হিসেবে বাড়ির ভিতরে কিশোর, যুবক এবং মধ্যবয়স্ক মানুষের কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলটিকে এখন “হামিন মঙ্গা” বলা হয় এবং এটি উত্তর-পূর্ব চীনের অন্যতম আকর্ষণীয় ও সংরক্ষিত প্রাগৈতিহাসিক অঞ্চল। প্রত্নতাত্ত্বিক এবং নৃতাত্ত্বিক গবেষণা ইঙ্গিত দেয় যে, মহামারীটি এত তাড়াতাড়ি ঘটেছিল যে যথাযথ দাফনের জন্য কোনো সময় ছিল না। এরপর এই অঞ্চলটিতে আর বসতি স্থাপন হয়নি।
“হামিন মঙ্গা”র সন্ধান পাওয়ার আগে উত্তর-পূর্ব চীনের মিয়াওজিগৌ নামে একটি অঞ্চলে পাওয়া গিয়েছিল একই সময়কালের আরেকটি প্রাগৈতিহাসিক গণসমাধি। একসাথে এই আবিষ্কারগুলো প্রমাণ করে যে, এই মহামারী পুরো অঞ্চলকে ধ্বংস করে দিয়েছিলো।
(২) অ্যাথেন্সের প্লেগ: (৪৩০ খৃষ্টপূর্বাব্দ)
অ্যাথেন্স এবং স্পার্টার মধ্যকার যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন পর অ্যাথেন্সের মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলো এক মহামারীতে এবং এটি পাঁচ বছর স্থায়ী ছিল। কিছু ঐতিহাসিক অনুমান থেকে মৃতের সংখ্যা ১০লক্ষ বলে জানা যায়। যা তুলে ধরেছেন গ্রীক ঐতিহাসিক থুসিডাইডস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৬০-৪০০), এ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন যে- “স্বাস্থ্যবান লোকরাও হঠাৎ করেই মাথার মধ্যে তীব্র উত্তাপের দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং চোখের মধ্যে লাল লাল ভাব, প্রদাহ দেখা দেয়, সেই সাথে গলা বা জিহ্বার মতো অভ্যন্তরীণ অংশ রক্তাক্ত হয়ে ওঠে এবং এসময় তাদের শ্বাসপ্রশ্বাস হয় অস্বাভাবিক এবং পূতিগন্ধময়।” (“The History of the Peloponnesian War,” London Dent, 1914).
এই মহামারীটি ঠিক কী ছিল তা বহু আগে থেকেই বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্কের বিষয়বস্তু। টাইফয়েড জ্বর এবং ইবোলাসহ অনেকগুলি রোগকে সম্ভাবনা হিসেবে সামনে রাখা হয়। অনেক গবেষক বিশ্বাস করেন যে, যুদ্ধের ফলে অধিক লোকসমাগম মহামারীটিকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। স্পার্টার সেনাবাহিনী শক্তিশালী ছিল এবং এথেনিয়ানদেরকে তারা তাদের শহরকে সুরক্ষিত করে রাখা “long walls” নামে একটি দুর্গের পিছনে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছিল। মহামারীটি সত্ত্বেও, যুদ্ধ অব্যাহত ছিল এবং তা ৪০৪ খৃষ্টপূর্ব অবধি শেষ হয়নি, যখন অ্যাথেন্সকে স্পার্টার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
(৩) অ্যান্টনাইন প্লেগ: (১৬৫-১৮০ খৃষ্টাব্দ)
“সৈন্যরা যখন প্রচারণা চালিয়ে রোমান সাম্রাজ্যে ফিরে আসে, তারা বিজয়ের লুণ্ঠনে প্রাপ্যের চেয়ে বেশি ফিরিয়ে আনে।” এটি ছিলো অ্যান্টোনাইন প্লেগ, যা সৈন্যদলকে আক্রান্ত করেছিল এবং রোমান সাম্রাজ্যের ৫ মিলিয়নেরও অধিক লোক এতে মারা যায়।”
(April Pudsey, a senior lecturer in Roman History at Manchester Metropolitan University, in a paper published in the book “Disability in Antiquity,” Routledge, 2017).
অনেক ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন যে, পার্থিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরে সৈন্যরা যখন দেশে ফিরে আসে, তখন সৈন্যদের দ্বারা মহামারীটি প্রথম রোমান সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। মহামারীটি “Pax Romana” (the Roman peace) যুগ সমাপ্তির ক্ষেত্রে অবদান রেখেছিল। এই যুগটি ছিলো ২৭ খৃষ্টপূর্বাব্দ থেকে ১৮০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত। এই সময়কালে রোম তার শক্তির শিখরে ছিল। এরপর পুরো রোমান সাম্রাজ্যে অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়, পুরো সাম্রাজ্য তখন “বর্বর” গোষ্ঠীগুলির দ্বারা গৃহযুদ্ধ এবং আগ্রাসনের সম্মুখীন হয়েছিল। প্লেগ সংঘটিত হওয়ার পর সেখানে খ্রিস্টধর্ম ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
(৪) সাইপ্রিয়ান প্লেগ: (২৫০-২৭১ খৃষ্টাব্দ)
সেন্ট সাইপ্রিয়ান নামে পরিচিত কার্থেজ’র(তিউনিসিয়ার একটি শহর) এক বিশপ, যিনি মহামারীটিকে পৃথিবী ধ্বংসের ইঙ্গিত হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। সাইপ্রিয়ান প্লেগটির কারণে কেবল রোমেই, আনুমানিক ৫০০০ মানুষ মারা গিয়েছিল একদিনে। ২০১৪ সালে, লাক্সারের প্রত্নতাত্ত্বিকরা একটি সমাধি খুঁজে পেয়েছিলেন, যা প্লেগ আক্রান্তদের সমাধিস্থল বলে মনে হয়। তাদের দেহগুলো চুনের একটি ঘন স্তর দিয়ে ঢাকা ছিল(প্রাগৈতিহাসিকভাবে চুন একটি জীবাণুনাশক হিসাবে ব্যবহৃত হয়)। প্রত্নতাত্ত্বিকরা দেখতে পান যে, চুন তৈরিতে ব্যবহৃত তিনটি ভাটি এবং প্লেগ আক্রান্তদের দেহাবশেষ একটি দানবীয় আগুনে পুড়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত নন যে কোন রোগটি মহামারীটি সৃষ্টি করেছিল। “স্থির প্রবাহে শিথিল হয়ে আন্ত্রিকভাবে শরীরের শক্তিসঞ্চার করে [এবং] মজ্জার গাঁথুনিতে আগুনের কুন্ডলির মতো ক্ষতে পরিণত হয় (মুখের একটি অঞ্চল)”, সাইপ্রিয়ান ল্যাটিন ভাষায় এই কথাগুলো লিখেছিলেন “দে মরেটিয়েট”(De mortalitate) নামে একটি বইয়ে। (“Fathers of the Third Century: Hippolytus, Cyprian, Caius, Novatian, Appendix,” Christian Classics Ethereal Library, 1885)
(৫) জাস্টিনিয়ান প্লেগ: (৫৪১-৫৪২ খৃষ্টাব্দ)
বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যটি বুবোনিক প্লেগ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল, যাকে এই সাম্রাজ্যের পতনের শুরু হিসেবে ধরা হয়। পরবর্তীতে বেশ কয়েকবার প্লেগ পুন: পুন: আক্রমণ করে। কিছু ঐতিহাসিকের অনুমান অনুযায়ী, এর ফলে বিশ্বের জনসংখ্যার ১০ ভাগ পর্যন্ত মারা গিয়েছিলো। প্লেগটির নাম বাইজেন্টাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ান (শাসনকাল ৫২৭-৫৬৫ খৃষ্টাব্দ) এর নামানুসারে করা হয়েছে। তাঁর শাসনামলে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য সর্বাধিক বিস্তার লাভ করেছিলো এবং মধ্য প্রাচ্য থেকে পশ্চিম ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে। জাস্টিনিয়ান সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে (আধুনিক ইস্তাম্বুল) Hagia Sophia (“Holy Wisdom”) নামে পরিচিত একটি বিশাল ক্যাথেড্রাল নির্মাণ করেছিলেন। জাস্টিনিয়ান প্লেগের মাধ্যমে অসুস্থ হয়ে বেঁচেও গিয়েছিলেন। তবে, মহামারীটি আঘাত হানার পরে ধীরে ধীরে তার সাম্রাজ্য অঞ্চল হারাতে থাকে।
(৬) দ্য ব্ল্যাক ডেথঃ (১৩৪৬-১৩৫৩ খৃষ্টাব্দ)
দ্য ব্ল্যাক ডেথ এশিয়া থেকে ইউরোপের দিকে বিস্তার লাভ করেছিল এবং তার যাত্রাপথে ধ্বংসের ছাপ রেখে গিয়েছিলো। কিছু অনুমান অনুসারে এটির ফলস্বরূপ ইউরোপের অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এটি ইয়ারসিনিয়া (Yersinia) পেস্টিস ব্যাকটিরিয়ামের একটি স্ট্রেনের কারণে ঘটেছিল, যা সম্ভবত আজ বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং এটি মাছির মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। এই মহামারীতে নিহতদের মরদেহ গণকবরে সমাহিত করা হয়।
মহামারীটি ইউরোপের ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিয়েছিলো। অনেক মৃত্যুর ফলে, শ্রমিক খুঁজে পাওয়া আরো কঠিন হয়ে পড়েছিল, শ্রমিকদের ভাল বেতনের জন্য ইউরোপের
ভূমি দাসত্ব ব্যবস্থার পতন ঘটে। গবেষণাদি থেকে প্রমাণিত হয় যে, বেঁচে থাকা শ্রমিকদের মাংস এবং উচ্চমানের রুটি দেয়া হতো। সস্তা শ্রমের অভাব প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনেও ভূমিকা রাখে।
(৭) কোকোলজিটলি মহামারী: (১৫৪৫-১৫৪৮ খৃষ্টাব্দ)
যে সংক্রমণটি কোকোলজিটলি (cocoliztli) মহামারী ঘটিয়েছিল তা হলো এক ধরণের ভাইরাল হেমোরজিক জ্বর, যার মাধ্যমে মেক্সিকো এবং মধ্য আমেরিকার ১৫ মিলিয়ন বাসিন্দার মৃত্যু ঘটেছিলো। ইতিমধ্যে চরম খরা দ্বারা দুর্ব্ এমন একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই রোগটি সম্পূর্ণ বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল । কোকোলজিটলি (cocoliztli) শব্দটি পোকা (Pest) এর Aztec প্রতিশব্দ।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় ভুক্তভোগীদের কঙ্কাল থেকে ডিএনএ পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, তারা এস প্যারাটিফি সি (S. paratyphi C) নামে পরিচিত “সালমোনেলা”-র একটি উপ-প্রজাতিতে সংক্রামিত হয়েছিল, যা এন্ট্রিক জ্বর (টাইফয়েড সহ এক ধরণের জ্বর) এর কারণে হয়। এন্টারিক জ্বর উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর, ডিহাইড্রেশন এবং গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে এবং এটি আজও একটি বড় স্বাস্থ্য হুমকির কারণ।
(৮) আমেরিকান প্লেগঃ (ষোড়শ শতাব্দী)
আমেরিকান প্লেগ ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের কর্তৃক আমেরিকাতে নিয়ে আসা ইউরেশিয়ান রোগের একটি গুচ্ছ (cluster), Smallpox সহ এই অসুস্থতাগুলো ইনকা এবং অ্যাজটেক সভ্যতার পতনের জন্য অবদান রেখেছিল। কিছু অনুমান অনুযায়ী পশ্চিম গোলার্ধে আদিবাসীদের মধ্যে ৯০ ভাগ লোক এই মহামারীতে মারা যায়।
এই মহামারীর ফলে ১৫১৫ সালে হার্নান কর্টেসের (Hernán Cortés ) নেতৃত্বে একটি স্পেনীয় বাহিনী তেনোচিটলিন (Tenochtitlán ), যা ছিলো অ্যাজটেক সাম্রাজ্যের রাজধানী এবং ১৫৩২ সালে ফ্রান্সিসকো পিজারোর নেতৃত্বে আরেক স্প্যানিশ বাহিনী ইনকা সাম্রাজ্য জয় করেন। স্প্যানিশরা উভয় সাম্রাজ্য দখল করেছিল। উভয় ক্ষেত্রেই, অ্যাজটেক এবং ইনকান সেনাবাহিনী রোগ দ্বারা বিধ্বস্ত হয়েছিল এবং স্প্যানিশ বাহিনীকে প্রতিহত করতে অক্ষম ছিল। ব্রিটেন, ফ্রান্স, পর্তুগাল এবং নেদারল্যান্ডসের নাগরিকরা যখন পশ্চিম গোলার্ধের অন্বেষণ, বিজয় এবং নিষ্পত্তি শুরু করে, তখন তারা এই সত্যও উপলব্ধি করে যে, এই রোগ/মহামারী যে কোনও আদিবাসী গোষ্ঠীর বিরোধিতার আকারকে ব্যাপকভাবে হ্রাস করে।
(৯) গ্রেট প্লাগ অফ লন্ডনঃ (১৬৬৫-১৬৬৬ খৃষ্টাব্দ)
গ্রেট ব্রিটেনে ব্ল্যাক ডেথের পর সর্বশেষ বড় আকারের মহামারীর প্রাদুর্ভাব রাজা চার্লস (দ্বিতীয়)’র নেতৃত্বে লন্ডন থেকে একটি গণপরিবর্তন ঘটায়। মহামারীটি ১৬৬৫ সালের এপ্রিল মাসে শুরু হয়েছিল এবং গ্রীষ্মের মাসগুলোতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। প্লেগ-সংক্রামক হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল মাছি। মহামারীটি শেষ হওয়ার সাথে সাথে লন্ডনের ১৫% জনসংখ্যা বা প্রায় ১লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল। তবে এই শহরের দুর্ভোগের শেষ ছিল না। ২ সেপ্টেম্বর, ১৬৬৬ সালে, লন্ডনের গ্রেট ফায়ার শুরু হয়েছিল, যা চার দিন ধরে স্থায়ী হয়েছিল এবং শহরের একটি বড় অংশ পুড়িয়ে দিয়েছিলো।
(১০) গ্রেট প্লাগ অফ মারসিলিঃ (১৭২০-১৭২৩ খৃষ্টাব্দ)
ঐতিহাসিক রেকর্ডে বলা হয় যে, ফ্রান্সের মার্সেইতে গ্র্যান্ড-সেন্ট-এন্টোইন (Grand-Saint-Antoine) নামে একটি পণ্যবাহী জাহাজ যখন পূর্ব ভূমধ্যসাগর থেকে যাচ্ছিলো তখন থেকে মার্সিলির মহামারী শুরু হয়েছিল। যদিও জাহাজটি পৃথক (কোয়ারেন্টাইন) করে দেওয়া হয়েছিল, তারপরেও শহরে প্লেগ প্রবেশ করেছিল।
মহামারীটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং পরবর্তী তিন বছরে মার্সেই এবং আশেপাশের অঞ্চলে প্রায় এক লক্ষ মানুষ মারা যায়। এটি অনুমান করা হয় যে, মার্সেইয়ের জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো।
(১১) রাশিয়ান প্লেগঃ (১৭৭০-১৭৭২ খৃষ্টাব্দ)
রাশিয়ায় প্লেগের থেকে বড় সমস্যা দেখা গেল তখনই, যখন লোকজন আতংকিত হয়ে সহিংসতার দিকে পা বাড়ালো। পুরো শহরে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে সেই সময়ে এবং সেটা আরো জোরালো হয় আর্চ বিশপ এ্যাব্রোসিয়াসকে হত্যার মাধ্যমে যিনি প্রকাশ্যে জনসমাগম এবং প্রার্থনা কে নিরুৎসাহিত করছিলেন।
রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী ক্যাথেরিন II (যিনি ক্যাথেরিন দ্য গ্রেট নামেও পরিচিত) এই মহামারি ঠেকাতে এবং জনজীবনে শান্তি ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। এই লক্ষ্যে তিনি তাড়াতাড়ি একটি ডিক্রি জারি করেন যার সারমর্ম ছিলো সকল কল-কারখানা মস্কো থেকে সরিয়ে দেবার জন্য। বলা বাহুল্য, শিল্প বিপ্লবের সেই যুগে মস্কো হয়ে উঠেছিলো জনসমাগমপূর্ণ একটি অঞ্চল। সিদ্ধান্তটা কাজে লেগেছিলো, কিন্তু যখন প্লেগের প্রভাব কেটে গেল ততদিনে প্রায় ১লক্ষ জন লোক মারা গেছেন। মস্কোর শান্তি ফিরাতে ক্যাথেরিনকে খুব সংগ্রাম করতে হয়েছিলো। ১৭৭৩ সালে দৃশ্যপটে আগমন ঘটে ইয়েমেলিয়ান পুগাচেভ যিনি নিজকে পিটার তৃতীয় দাবি করেন, একটি বিদ্রোহের শুরু করেন যা আরো লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানির কারণ হয়।
Related Article:হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতি কি আসলেই কার্যকরী?
(১২) ফিলাডেলফিয়া ইয়েলো ফিভার মহামারিঃ (১৭৯৩ খৃষ্টাব্দ)
তখন ফিলাডেলফিয়া ছিল আমেরিকার রাজধানী। যখন সেখানে ইয়েলো ফিভারের আক্রমণ শুরু হয় তখন অনেক ভুল ধারণার ভেতর একটা ধারণা ছিলো যে, কালো দাসরা এই রোগের বিপক্ষে প্রতিরোধক্ষম। ফলে শাসক গোষ্ঠী থেকে কালো বা আফ্রিকান উৎস থেকে আগত মহিলাদের নার্স হিসেবে নিয়োগ দেওয়া শুরু হল।
আসলে ইয়েলো ফিভার ছড়ায় মশার মাধ্যমে। সে বছর ফিলাডেলফিয়ার গরম আর ভেজা আবহাওয়ায় মশাদের জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটেছিলো। ফলে প্রচুর লোক আক্রান্ত হতে থাকে। আবার শীত আসা মাত্র মশার সংখ্যা কমে যায়, ফলে মহামারির তীব্রতাও কমে যায়। কিন্তু, ততদিনে প্রায় ৫০০০ লোকের প্রাণহানি ঘটে।
(১৩) ফ্লু মহামারিঃ (১৮৮৯-১৮৯০ খৃষ্টাব্দ)
আধুনিক শিল্পযুগে উদ্ভাবিত নতুন যানবাহনগুলো ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের জন্য এক রকম আশির্বাদ হয়েই আসে।অতি দ্রুত ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়তে থাকে।কয়েকমাসের ভেতরই এটা পুরো বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রায় এক মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়।আশ্চর্যজনক হলেও সত্য ,মাত্র পাচ সপ্তাহের ভেতর এটি সর্বোচ্চ মৃত্যুহার এ পৌছাতে সক্ষম হয়।
সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় রাশিয়ায়।ভাইরাসটি খুব দ্রুত সেন্ট পিটার্সবার্গে ছড়াতে থাকে ইউরোপে ছড়ানোর আগে।
(১৪) আমেরিকান পোলিও মহামারিঃ (১৯১৬ সাল)
পোলিও মহামারি আমেরিকাতে শুরু হয়েছিল ২৭০০০ কেস আর ৬০০০ মৃত্যু নিয়ে। রোগটা প্রধানত বাচ্চাদের আক্রান্ত করতো এবং যারা বেঁচে থাকতো তারা চিরস্থায়ী পঙ্গুত্ব বরণ করে নিতে হতো। পোলিওর আক্রমন নিয়মিত না হয়ে একটা বিরতি দিয়ে হতে থাকে এবং আস্তে আস্তে কমতে থেকে যখন ১৯৫৪ সালে স্যাক ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়। ধীরে ধীরে এই ভ্যাকসিন সহজলভ্য হয় এবং পুরো পৃথিবী থেকে পোলিও নির্মূল করা সম্ভব হয়।
(১৫) স্প্যানিশ ফ্লুঃ (১৯১৮-১৯২০ খৃষ্টাব্দ)
এটার উৎপত্তি হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। দক্ষিণ মেরুর সাগর পাড় থেকে উত্তর মেরু পর্যন্ত প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয়। যাদের প্রায় পাঁচ ভাগের একভাগ মারা যান। অনেক উপজাতি প্রায় বিলুপ্তির দিকে চলে যায়। সৈন্য আর পুষ্টিহীন জনগোষ্ঠীর ভেতর রোগটি আরো প্রাণঘাতি হয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
নাম স্প্যানিশ ফ্লু হলেও এর উৎপত্তি স্পেন থেকে নয়। আসলে যুদ্ধের সময় স্প্যানিশ পত্রিকার উপর কোন সেন্সর না থাকায় তারা এই সংবাদ প্রকাশ করতে থাকে। ফলে এই ফ্লু এর নাম হয় যায় স্পেনিশ ফ্লু।
(১৬) এশিয়ান ফ্লুঃ (১৯৫৭-১৯৫৮ খৃষ্টাব্দ)
ইনফ্লুয়েঞ্জার আরেকটা আঘাত, এবার ঘটনাস্থল এশিয়া। চীন থেকে এর উৎপত্তি এবং সারা বিশ্ব জুড়ে প্রায় এক মিলিয়ন প্রাণহানির কারণ হয়। ভাইরাসটি মহামারী ঘটায় এভিয়ান ফ্লু ভাইরাস এর সাথে একত্রিত হয়ে। Center for Disease control and prevention এর তথ্য মতে, ফেব্রুয়ারি ১৯৫৭ তে সিঙ্গাপুরে, হংকংয়ে এপ্রিল ১৯৫৭ এবং আমেরিকার উপকূলে গ্রীষ্মে ১৯৫৭ তে এর প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। সর্বমোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় বিশ্বজুড়ে ১.১ মিলিয়ন যার মধ্যে আমেরিকাতেই এক লক্ষের অধিক।
(১৭) এইডস মহামারীঃ (১৯৮১-বর্তমান)
প্রথম শনাক্তকরণের পর থেকে রোগটি প্রায় ৩৫ মিলিয়ন জীবন হানির কারণ হয়েছে। HIV ভাইরাসটি শিম্পাঞ্জি থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ে ১৯২০ সালের দিকে। বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এখন সাব-সাহারান আফ্রিকায় বসবাসরত ৪০ মিলিয়ন মানুষের ভেতর ৬৪% মানুষই এই ভাইরাস বহন করছে। ১৯৯০ তে আবিষ্কৃত কিছু ঔষধ মানুষকে স্বাভাবিক জীবনযাপনে সাহায্য করছে।
Related Article :স্প্যানিশ ফ্লু: মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী এই মহামারির ইতিহাস
(১৮) H1N1 সোয়াইন ফ্লু মহামারীঃ (২০০৯-২০১০ সাল)
সোয়াইন ফ্লুর উৎপত্তি মেক্সিকোতে, ২০০৯ সালের বসন্তে এটি মেক্সিকোতে ছড়িয়ে পড়ে এবং আস্তে আস্তে সারাবিশ্বে। এক বছরের মধ্যে এই ফ্লু প্রায় ১.৪ মিলিয়ন লোককে আক্রান্ত করে এবং সিডিসির হিসাব মতে, দেড় লক্ষ থেকে প্রায় ছয় লক্ষ লোকের মৃত্যুর কারণ হয়। প্রধান্ অল্প বয়স্ক লোকেরা বেশী আক্রান্ত হলেও বৃদ্ধদের ভেতর এর কোন প্রভাব দেখা যায়নি।
(১৯) পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলা মহামারিঃ (২০১৪-২০১৬ সাল)
২০১৪ সাল থেকে ২০১৬, আফ্রিকয় ইবোলার প্রভাবে প্রায় ২৮৬০০ জন অসুস্থ হয় এবং ১১৩২৫ জনের মৃত্যু হয়। প্রথম ঘটনা ছিলো ডিসেম্বর ২০১৩ তে, গুয়েনায় এবং খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে লাইবেরিয়া ও সিয়েরালিওনে। এই তিন দেশেই বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ইবোলার কোনো প্রতিষেধক নেই, তবে একটি ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের চেষ্টা চলে এবং ভাইরাসটি বাদুড় থেকে এসেছে বলে ধারণা করা হয়। যদি আদি ইতিহাস দেখা হয়, তবে সুদান আর কঙ্গো তে ১৯৭৬ সালে এই রোগের প্রকোপ দেখা গিয়েছিলো।
(২০) জিকা ভাইরাস মহামারিঃ (২০১৫-বর্তমান)
দক্ষিণ আমেরিকা আর মধ্য আমেরিকাতে এই রোগটি বেশ কয়েক বছর ধরে পরিচিত। একে নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিজ্ঞানীরা যথেষ্ট হিমশিম খাচ্ছেন। মশার ভেতর এডিস গণের মশার মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায়। আবার আক্রান্ত মানুষের সাথে যৌন সঙ্গমের মাধ্যমে এটি ছড়াতে পারে।
জিকা পুর্ণবয়স্ক মানুষের জন্য ক্ষতিকর না হলেও, অপ্রাপ্তবয়স্ক বাচ্চাদের জন্য মারাত্মক।