ভালবাসা, এই এক ছোট শব্দে আছে হাজার অনুভূতির মিশ্রন। কত সহস্র কবিতা, গান, উপন্যাস রচিত এই এক ভালবাসা নিয়ে। কতশত সত্যিকারের ইতিহাসও রচিত এই ভালবাসা ঘিরে। দূর থেকে দূরে এক অকৃত্রিম ভালবাসায় বেধে থাকে হাজার জুটি। কিন্তু এই ভালবাসার পিছনেও রয়েছে ব্যাখা, রয়েছে কারণ।
ভালোবাসা এক ধরনের ইতিবাচক অনুভূতি। ইতিবাচক এই আবেগের পিছনে রয়েছে এক গোপন তাগিদ। ভালোবাসায় নিজের ভিতর শক্তি সঞ্চারিত হয়, উদ্যম জেগে উঠে। তবে কোথা থেকে আসে এই শক্তি? এখানে যেমনটি রয়েছে আবেগের ভূমিকা, তেমনি আছে হরমোন সহ বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানের ক্রিয়া-বিক্রিয়ার খেলা। এ রাসায়নিক পরিবর্তন আমাদের জীবনের নানা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে আর বদলাতে ভূমিকা রাখে। আবেগ অনুভূতির পিছনে যে দুটি হরমোনের আধিক্য রয়েছে তা হচ্ছে ইস্ট্রোজেন (স্ত্রী হরমোন) এবং টেস্টোস্টেরন (পুরুষ হরমোন)।
নারী-পুরুষের শারীরিক গড়ন নির্ভর করে এই দুটি হরমোনের আনুপাতিক হারের উপর। রাসায়নিক উপাদানের বিক্রিয়ার ফলে প্রেম-ভালোবাসা এবং মানবিক তীব্র আবেগ অনুভূতিগুলো নিয়ন্ত্রিত হয়। সাম্প্রতিক গবেষণায় নতুন নতুন তথ্য পাওয়া গিয়েছে এবং যেসব রাসায়নিক উপাদানের কথা নিয়ে আলোচনা বেশি হচ্ছে : এমফিটামিনস, ফিনাইলথ্যালামিন বা পি পদার্থ (Substance P), নরইপিনেফ্রিন, এন্ডোরফিনস, অক্সিটোসিন, সেরোটোনিন ইত্যাদি।
এমফিটামিনস: মোহনীয় চাহনি, হাসির আবেদন কিংবা হঠাৎ স্পর্শে মস্তিষ্কে এমফিটামিনসের নিঃসরণ ঘটে যায়। তবে এখানে জেনে রাখা ভালো, এমফিটামিনস ঔষধ হিসেবে বাজারেও পাওয়া যায়। এটি সাইকোস্টিমুলান্ট এজেন্ট হিসেবে মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বয়স্কদের ঘুম রোগ নারকোলেপসি এবং শিশুদের হাইপারকাইনেটিক ডিসঅর্ডারে ব্যবহার করেন।
ফিনাইলথ্যালামিন: ফিনাইলথ্যালামিন বা পি পদার্থের কারণে জেগে উঠে ভালবাসার তীব্র আকুলতা। কিন্তু একই মুখ, একই চোখ, একই স্পর্শে এই পদার্থের নিঃসরণ এর মাত্রা দীর্ঘদিন একই রকম থাকে না। সময়ের সাথে সাথে এটি নিঃসরণের মাত্রা এবং প্রতিক্রিয়া তীব্রতা হ্রাস পায়। ভালোবাসার জোয়ারে তখন চলে আসে ভাটির টান। এই পদার্থের নিম্নগতি শুরু হলেই বিচ্ছেদের সম্ভাবনা দেখা যায়। শরীর-মনের পুলকিত তাগিদ কমে যায় রাসায়নিক উপাদানের টলারেন্সের কারণে। এই টলারেন্স তৈরি হতে স্নায়ুতন্ত্রের সময় লাগে সর্বোচ্চ চার বছর।
কিন্তু এর পরও তো, বিয়ে টিকে থাকে, ভালোবাসা দীর্ঘায়িত হয় অনেকেরই জীবনে। এমনকি পশ্চিমা দেশগুলোতেও গড়ে চারটি বিয়ের মধ্যে তিনটি টিকে যায়। তাহলে কি কারণ এর পিছনে? যখন দুজন মানুষ একসাথে অনেক বছর কাটিয়ে দেয়, বিশেষত, এরেঞ্জ ম্যারেজে যখন দুটি আলাদা সত্ত্বা অদৃশ্য এক মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে যায় তখনই তারা আর সহজে আলাদা হয়না। এটি আমরা আমাদের দেশে বাবা-মাদের মধ্যেই দেখতে পাই। এই মায়ার বাধনে শক্ত গিট এটে দেয় এন্ডোরফিনস নামক রাসায়নিক উপাদান এবং অক্সিটোসিন নামক হরমোন।
এন্ডোরফিনস দুজনের মধ্যে শান্ত, সৌম্য, নিরাপত্তা অনুভূতি জাগায়, উন্মাতাল ঢেউ জাগায় না। প্রধানত উত্তাল অনুভূতি তৈরি হয় কম বয়সী প্রেমিক-প্রেমিকাদের মধ্যে। এর পেছনে দায়ী ফিনাইলথ্যালামিন বা পি পদার্থ। কম বয়সের প্রেম দ্রুত মিলিয়ে গেলেও নিঃশেষ হয়ে যায় না। নতুন মুখ, নতুন চোখ, নতুন হাসি, তুমুল উদ্দীপনায় আবার মস্তিষ্ককে উদ্দীপ্ত করে নতুন করে সমান মাত্রায় পদার্থের নিঃসরণ বাড়িয়ে তুলতে পারে।
নতুন প্রেমের জোয়ার পূর্ণ উদ্যমে আবার চলে আসে এভাবেই। অন্যদিকে এন্ডোরফিনস স্থিতি নিয়ে আসে বিধায়, প্রেমিক প্রেমিকা বা স্বামী-স্ত্রী নিজেদের অনেক ভুল-ত্রুটি সয়ে নিতে পারে, সমঝোতায় আসতে পারে, তাদের মধ্যে ভালো বোঝাপড়া হয়। হুট করে তারা অন্যের প্রতি আসক্ত হয় না এদের ভালোবাসা চলে যায় না বা রং বদলায় না।
দাম্পত্য-জীবনে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল ও যত্নশীল হওয়ার পিছনে অক্সিটোসিন হরমোনের বিরাট অবদান রয়েছে। যত বেশি এই রাসায়নিক উপাদানটি নিঃসরণ ঘটবে তত বেশি উপায় পরস্পরের কাছে যাবে। অক্সিটোসিন মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারগুলো সক্রিয় করে তোলে। গবেষণায় দেখা গেছে, অক্সিটোসিন এন্ডোরফিনসের নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয়। এন্ডোরফিনস মনকে শান্ত করে, উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা দূর করে। অক্সিটোসিন কে অফুরন্ত ভালোবাসা উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিজ্ঞানীরা। মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্ল্যান্ড এর পশ্চাৎ থেকে নিঃসরণ ঘটে অক্সিটোসিন হরমোনটির। এটি প্রধানত জরায়ুর পেশী সংকোচন এর মাধ্যমে সন্তান প্রসবের মূল কাজটি করে থাকে।
আমেরিকাতে সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে যে, মানসিকভাবে বিধ্বস্ত মানুষদের দেহে যথা সময়ে সঠিক মাত্রায় অক্সিটোসিন হরমোনের নিঃসরণ ঘটে না। ক্রোধ, উত্তেজনার কিংবা মানসিক চাপযুক্ত অবস্থায় এড্রেনালিন হরমোনের নিঃসরণ ঘটে বেশি মাত্রায় যা অক্সিটসিন নিঃসরণে বাধার সৃষ্টি করে। যত বেশি ক্রোধ চাপা থাকবে ততবেশি ভালোবাসার বন্ধন অক্সিটোসিনের অভাব হতে থাকবে। সুইডেনের গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন, এই হরমোন কমে গেলে বন্ধুভাবাপন্ন অনুভূতিতে ধ্বস নামে।
দেহ-মনে রসায়নের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কয়েকজন বিজ্ঞানী সাম্প্রতিক সময়ে প্রেমকে এক ধরণের উম্মাদনা বলে আখ্যায়িত করেছেন। প্রেমে আক্রান্ত নর-নারীর চিন্তা আচরণ যেন স্বপ্নরাজ্যে ভেসে বেড়ায়, এক ধরনের ঘোরের মধ্যে ডুবে যায় তারা। আচ্ছন্নতা গ্রাস করে তাদের সব চাওয়া-পাওয়া, ইচ্ছে অনুভূতিকে। প্রেমের এই বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে বিজ্ঞানীরা Obsessive compulsive disorder (OCD) এর মিল দেখতে পেয়েছেন। ওসিডি আক্রান্তদের মনে একই চিন্তা বারবার মনের মধ্যে জেগে উঠে। যারা প্রেমে পরে তাদের ভিতরেও একই চিন্তা একই মুখ বারবার মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। একই উদ্বেগ, অনুভূতি, আশঙ্কা মনের ভিতর ক্রমাগত ঘুরপাক খেতে থাকে।
এগুলো পড়তে ভুলবেন না ! স্টকহোম সিন্ড্রোম : অপরাধীর প্রতি সমর্থন যখন মনোবৈকল্য ! |
ইতালির পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডেনোটেলা মারজিটি এবং যুক্তরাষ্ট্রের বায়োলজিস্ট ডিন হ্যামারের গবেষণার ফলাফল থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয়েছে যে, OCD তে নিউরোট্রান্সমিটার সেরোটোনিনের মাত্রা কমে যায় তেমনি ভালবাসায় আক্রান্ত নারী-পুরুষের সেরোটোনিনের মাত্রা কম থাকে। তবে তাই বলে ভালোবাসাকে আমরা মানসিক রোগ হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারিনা। এজন্য দরকার আমাদের আরো সুনির্দিষ্ট গবেষণা। দেখা যাক গবেষকরা আর কত দূর এগিয়ে যেতে পারে এই ভালবাসার রসায়ন ভেদ করতে।
সূত্র:- মানবমনের গতিপ্রকৃতি