আমরা দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্নরকম কাজকর্ম করে থাকি। সকালে ঘুম থেকে উঠা শুরু করে স্কুল, কলেজ কিংবা ইউনিভার্সিটি তে যাচ্ছি ; সেখান থেকে আবার সারাদিনের কাজকর্ম শেষে রাতে পড়তে বসছি কিংবা চাকুরিজীবি ব্যক্তিরা তাদের গুরুত্বপূর্ণ ফাইল বা ডকুমেন্টের যাবতীয় তথ্য স্মৃতি হিসেবে মনে রাখছে। আবার একজন ব্যবসায়ী তার যাবতীয় হিসাব-নিকাশ সম্পাদন করছে।
এত কাজ কি আমরা একাই করি নাকি আমাদের স্মৃতি এখানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে? তবুও স্মৃতি নিয়ে আমাদের অভিযোগের যেন শেষ নেই। মাঝে মাঝে পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে মনে হয় ইশ রে! এটা কেন মনে পড়ল না! তাই না? আরও কত অভিযোগ তো আছেই।
তবে স্মৃতি সম্পর্কে আপনি কতটুকুই বা জানেন? আমাদের মস্তিষ্ক একসাথে অনেকগুলো কার্যকলাপ সম্পন্ন করে থাকে। তন্মধ্যে নিউরনের ( স্নায়ুকোষের একক) বিভিন্ন গ্রুপ আছে যা বিভিন্ন ধরনের উদ্দীপনা বা উপলব্ধির জন্য দায়ী।
স্মৃতি গঠনঃ
স্মৃতি হলো নিউরনের একটি নির্দিষ্ট গ্রুপের পুনঃসক্রিয়করন। আপনি নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন একটি নিউরন অপর নিউরনের সাথে সংযোগ সাধন করে থাকে এবং নিউরনের এই সংযোগ শক্তির ক্রমাগত পরিবর্তন থেকেই স্মৃতি গঠিত। মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরনেরই কিছু কিছু গ্রুপ থাকে।
আপনারা যেমন কয়েকজন বন্ধু মিলে একটি গ্রুপ বা সার্কেল গঠন করেন তেমনি নিউরনের নিজস্ব কিছু গ্রুপ আছে। কিন্তু ব্যাপারটি কেমন দাড়ায় যখন নিউরনের কোনো একটি গ্রুপ অন্য আরেকটি গ্রুপকে টেক্কা দিয়ে উপরে উঠে যায়? এখানে টেক্কা বলতে নিউরনের পুনঃসক্রিয়করন কে বোঝানো হচ্ছে। এই ধরনের প্রক্রিয়া সিন্যাপটিক প্লাস্টিসিটি (Synaptic Plasticity) নামে পরিচিত।
সিন্যাপটিক প্লাস্টিসিটি হলো সিন্যাপস (দুটি নিউরনের সংযাগস্থল) এর সংযোগ দৃঢ়তার পরিবর্তন। দুটি নিউরনের মধ্যকার সংযোগ তখনই শক্তিশালী হবে যখন একটি নিউরন ধারাবাহিকভাবে অপর একটি নিউরনকে সক্রিয় হতে সাহায্য করবে। নিউরনের সংযোগস্থল তখনই দুর্বল হবে যখন একটি নিউরন অপরটিকে সক্রিয় করতে বাধাগ্রস্ত হবে। সক্রিয়তা দীর্ঘস্থায়ী হলে স্নায়ুবিজ্ঞানের ভাষায় একে ‘Long-term Potentiation’ এবং সক্রিয়তা ক্ষণস্থায়ী হলে তাকে ‘Long-term Depression’ বলে।
তবে একটি কথা না বললেই নয়, এটি তখনই সংঘটিত হবে যখন আপনি পূর্বে কোনো অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হবেন। গবেষকরা বলেছেন, আপনি যখন কোনো উদ্দেশ্যের সাথে যুক্ত হবেন তখনই আপনি সেগুলো মনে রাখতে পারবেন। কিন্তু স্মৃতি গঠিত হওয়ার জন্য সিন্যাপসের কার্যকর শক্তির পরিবর্তন কিংবা পুরাতন সংযোগ অপসারণ করে নতুন করে সংযোগ হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও কিছু প্লাস্টিসিটি আছে যা স্মৃতির গঠনের জন্য অনস্বীকার্য।
স্মৃতি সংরক্ষণঃ
স্মৃতি গঠিত হওয়ার পাশাপাশি এটি সংরক্ষিত থাকতে হবে নতুবা সেই স্মৃতি ভবিষ্যতে আর কাজে লাগানো যাবে না। গবেষকরা বলেছেন, মানুষের মস্তিষ্ক একটি স্মৃতির পুরোপুরি সংরক্ষণ করে রাখতে পারে না। বরং মস্তিষ্ক সেই স্মৃতি বিজড়িত কিছু তথ্য জমা রাখে যা প্রয়োজন অনুযায়ী পুনরায় সক্রিয় হয়। তথাপি, এটি নিউরনে ছোট ছোট খন্ডে এবং বিচ্ছিন্নভাবে ছড়ানো থাকে।
একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির মস্তিষ্কে হিপ্পোক্যাম্পাস (Hippocampus) নামক একটি গাঠনিক অঙ্গানু থাকে যা নিউরন সংযোগ গঠনে সহায়তা করে এবং এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় নিউরোজেনেসিস। হিপ্পোক্যাম্পাস নতুন স্মৃতি গঠন ও সংরক্ষণে সহায়তা করে। কিছু গবেষণায় দেখা যায়, আপনি যত বেশি ব্যায়াম করবেন, আপনার হিপ্পোক্যাম্পাসের ঘনত্ব সেক্ষেত্রে তুলনামূলক বৃদ্ধি পায়।
ফলস্বরূপ নতুন নতুন নিউরন গঠিত হয় এবং একই সময়ে স্মৃতির বিভিন্ন কার্যকলাপ ও কর্মদক্ষতাও বৃদ্ধি পায়। লক্ষ্য করার বিষয় হলো, আপনার হিপ্পোক্যাম্পাস যদি কোনক্রমে আঘাতপ্রাপ্ত হয় তাহলে আপনি কোনভাবেই আপনার স্মৃতি ফেরত আনতে পারবেন না অর্থাৎ পূর্বে ঘটা সবকিছু ভুলে যাবেন।
এগুলো পড়তে ভুলবেন না !!! মগজাস্ত্রের খোরাক : কিছু অ্যাপস ও গেম |
স্মৃতি স্মরণঃ
আপনার মস্তিষ্কে স্মৃতি গঠিত এবং সংরক্ষণ দুটোই হলো কিন্তু সেটি যদি স্মরণ নাই বা করতে পারেন তাহলে স্মৃতি রেখে কি লাভ! তাই না?
তাই স্মৃতির পাশাপাশি স্মরণও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনার মস্তিষ্ক যদি কোনো তথ্য সংরক্ষণ করে রাখে তবে সেই তথ্য পুনরায় ফিরিয়ে আনাকে বলা হয় স্মরণ। কোনো তথ্য স্মরণকালে সেই তথ্য সংবলিত স্মৃতিগুলো পুনর্গঠিত হয় যা আমরা আউটপুট হিসেবে পাই। কোনো অভিজ্ঞতার স্মৃতি সবসময় একরকম থাকে না যার ফলে সময়ের সাথে সাথে স্মৃতিও পরিবর্তিত হয়।
স্মৃতির ক্ষেত্রে ঘুমের অপরিহার্যতাঃ
স্মৃতি সংরক্ষিত হওয়ার ক্ষেত্রে ঘুমের বিকল্প অন্য কিছু নেই। বিজ্ঞ ব্যক্তিরা বলে দৈনিক নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী ৮ ঘন্টা ঘুমোতে। আপনি প্রায়ই শুনে থাকবেন যে রাতজাগা আমাদের শরীরের জন্য ভালো নয়। কিন্তু এমনটি ভেবেছেন যে রাতে না ঘুমোলে আপনার মস্তিষ্কে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে? তাহলে শুনুন, ঘুমের সময় হিপ্পোক্যাম্পাস ও নিওকর্টেক্স এদের মধ্যকার সংলাপে অংশগ্রহণ করে যেমনটি আপনি আপনার বন্ধুর সাথে করে থাকেন।
হিপ্পোক্যাম্পাল নিউরন ঘুমের সময় সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোকে একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর আপডেট করে যার ফলে আপনি সহজেই স্মৃতিগুলো ধরে রাখতে পারবেন, কিন্তু আপনি যদি ঠিকমতো না ঘুমান তাহলে মস্তিষ্ক সেই স্মৃতি ধরে রাখতে ব্যর্থ হবে।
প্রকৃতপক্ষে আমাদের মস্তিষ্কের ক্ষমতা এতটাই প্রবল যা আমাদের কল্পনার বাহিরে। ১৯৪১ সালে নিউরোফিজিওলজি তে একজন নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী স্যার চার্লস শেরিংটন মস্তিষ্ককে ‘জাদুকরী লুম’ (enchanted loom) বলে অভিহিত করেন।আবার, মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটির একজন প্রফেসর পিয়েটর আনোখিন (Pyotr Anokhin) বলেন, নিউরনের সংযোগ সংখ্যা ‘কার্যত অসীম’ (Virtually Infinite)।
সর্বোপরি স্মৃতি ছাড়া একজন মানুষ সম্পূর্ণরূপে অচল। এটি হলো একটি প্রক্রিয়া যে প্রক্রিয়ায় আমাদের উপলব্ধি করা সকল তথ্য মস্তিষ্কে জমা থাকে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী আমরা সে তথ্যগুলোকে কাজে লাগাই।